‘সতীন’ ফুলটুসি, গুমা এবং তাঁদের স্বামী উমাপদ। —নিজস্ব চিত্র।
দরজা খুললেন একদল মহিলা। কেউ কুড়ির আশপাশে। কেউ তিরিশ, কেউ পঞ্চাশ পার করেছেন। কেউ আর একটু বেশি।
বারান্দা পেরিয়ে বসার ঘর। ঘর পেরিয়ে রান্নাঘর। রান্নাঘর পেরিয়ে উঠোন। পরপর খাটিয়া পাতা। মেয়েদের দল সেখানে গিয়ে থামল। হাসি মুখে তাকালেন ফুলটুসি বাউরি। কপালে লাল টিপ, সিঁথিতে মোটা করে আঁকা সিঁদুর। ঝলমল করছে মধ্যবয়স্কার মুখ।
আগন্তুককে ফুলটুসি প্রশ্ন করলেন, ‘‘আমি কে বলুন তো?’’ কলকাতা থেকে যাওয়া ‘দিদিমণি’র তখন খানিক গুলিয়ে যাচ্ছে মুখগুলো। এত জনের সঙ্গে যে দেখা হবে, জানা ছিল না তো!
চিন্তা ভাঙালেন ফুলটুসি। উনুনে দেওয়ার কাঠ টুকরো করতে করতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ষাট-পেরোনো হাসিমুখের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘‘আমরা সতীন গো!’’ হাসি আরও চওড়া হল নীল শাড়ি জড়ানো সদ্য ঘরে-ফেরা বৃদ্ধার। এ বার তিনি এগিয়ে এসে বললেন, ‘‘আমিই তো সে। আমার সঙ্গেই তো দেখা করতে এসেছেন!’’
ছিলেন ভবানী মণ্ডল। হয়েছেন গুমা বাউরি! পরিজনেরা শুধরে দেবেন। বলতে হবে, ছিলেন গুমা বাউরি। ভাগ্যের ফেরে হয়েছিলেন ভবানী মণ্ডল। এখন তিনি আবার গুমা বাউরি। মাঝে কেটেছে ৩৭ বছর। বা তারও বেশি। স্মৃতিশক্তি সঙ্গ দেয়নি অনেক দিন। নাম জিজ্ঞাসা করলে গুমা গুলিয়ে ফেলেন এখনও। মাঝেমাঝেই বলে ফেলছেন, তিনি ‘ভবানী’। হই হই করে ঠিক করে দিচ্ছেন অন্যরা। এ সব নিয়েই এখন হাসিঠাট্টা চলছে বাউরি পরিবারে।
গত রবিবার, নভেম্বরের ২৮ তারিখ ‘বাড়ি’ ফিরেছেন গুমা। ৩৭ বছর তাঁর কোনও খোঁজ পায়নি পরিবার। এক দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন। বকখালিতে এক চায়ের দোকানের মালিক তাঁকে রাস্তায় দেখে থাকার জায়গা দেন। বাড়ি কোথায়, বলতে পারেননি গুমা। রাস্তাঘাট বিশেষ চিনতেন না। আর স্মৃতিশক্তিও কিছুটা দুর্বল হয়ে যায়। নিজের নাম পর্যন্ত গুলিয়ে যেত।
সেই থেকে ওই চায়ের দোকানেই এত কাল কাজ করে দিন কাটিয়েছেন। সেখানে তাঁকে ‘ভবানী’ বলেই চিনতেন অধিকাংশ মানুষ। সম্প্রতি হ্যাম রেডিয়োর সদস্যেরা গুমার কথা জানতে পারেন। বিভিন্ন জেলার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবশেষে তাঁর পরিজনদের খোঁজ মেলে। হ্যাম রেডিয়োর সদস্যদের চেষ্টায় গুমার বাড়ি ফেরার সেই খবর প্রথম প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার অনলাইনে। তার পরেই সাড়া পড়ে যায় চারদিকে।
এত বছর পর বাড়ি ফেরা সহজ কথা নয়। সচরাচর এমন ঘটনা দেখাও যায় না। ছায়াছবিকেও হার মানিয়েছে বাস্তব। ইতিমধ্যে বিয়ে করে ফেলেছেন গুমার স্বামী। তাঁদের ছেলেমেয়েরাও বড় হয়েছেন। সকলে কি গুমাকে জায়গা দেবেন তাঁদের জীবনে? বাড়ি ফিরে কেমন আছেন তিনি?
সে সব প্রশ্নের জবাব পেতে গুমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে আনন্দবাজার অনলাইন পৌঁছেছে বোকারোয়। পুরুলিয়া-ঝাড়খণ্ড সীমানায় ঝাড়খণ্ডের বোকারো জেলার চাস অঞ্চলের চৌরা গ্রামে গুমার বাড়িতে।
দেখা গেল, গ্রামে যেন অকাল উৎসব লেগেছে। দিনের কাজ কোনওমতে সেরে দলে দলে গ্রামবাসী জড়ো হচ্ছেন উমাপদ বাউরির বাড়ি। তাঁরই প্রথম স্ত্রী গুমা এত বছর পর ঘরে ফিরেছেন। সকলেই ধরে নিয়েছিলেন গুমা আর বেঁচে নেই। টানা সাত বছর কেউ নিখোঁজ থাকলে সরকার থেকে মৃত্যুর শংসাপত্র দেয়। গুমার ক্ষেত্রেও তেমন ঘটেছিল।
অনেকেই রাখী আর রেখার ‘বসেরা’ ছবি দেখেছেন। অথবা শাহরুখ খান-ঋষি কপূরের ‘দিওয়ানা’। মৃত ধরে নেওয়া স্ত্রী বা স্বামী বহু বছর পর ঘরে ফেরার টানাপড়েন কেমন, পর্দায় তা দেখা আছে। কিন্তু ছায়াছবি আর বাস্তবে ফারাক থাকে। সম্ভবত সেই কারণেই এত বছর পর গ্রামে ফিরেও সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো ‘ঘরছাড়া’ হতে হয়নি কাহিনির মুখ্য চরিত্র গুমাকে। কাছে টেনে নিয়েছেন সকলে। এমনকি সতীনও!
গুমার বয়স এখন ষাট পেরিয়েছে। গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, তাঁর চেহারাও একেবারে বদলে গিয়েছে। নতুন রূপে গুমাকে কেমন দেখাচ্ছে, সে কৌতূহল রয়েছে সকলের। গ্রামের মেয়েরা তাঁদের বাড়ি গেলেই আড্ডা জমে। শুরু হয় পুরনো দিনের কথা। তিন যুগ পার করে ফিরে-আসা অচেনা চেহারার এই মহিলা যে তাঁদেরই গাঁয়ের শঙ্করী-দুলালির মা, মেনে নিতে বেশি সময় লাগে না।
নিজের নাম গুলিয়ে গেলেও গ্রামের আচার-অনুষ্ঠানের কথা জ্বলজ্বল করছে গুমার মনে। শ্বশুরবাড়ির এমন আত্মীয়দের কথাও মনে আছে গুমার, যাঁদের হয়তো গত তিরিশ বছরে বিশেষ দেখেনওনি ফুলটুসি। আমাকে সে সব কথা মজা করে শোনাতে থাকেন বাড়ির বউ-মেয়েরা। চলে ঠাট্টা— ‘‘কী গো বড়মা, আবার কলকাতা যাবে নাকি?’’ বড়মা বলতে থাকেন, ‘‘আর কোথাও যাব না!’’
গুমা অবশ্য কলকাতায় ছিলেন না। এত বছর ছিলেন বকখালিতেই। পরিজনদের বার বার সে কথা বোঝানোর চেষ্টা করেন বৃদ্ধা। জানান, বকখালিতে এক চায়ের দোকানে কাজ করেছেন। সেখানে সকলে ভালবেসেছেন তাঁকে। চৌরা গ্রামের বউরা অবাক হয়ে শোনেন। কলকাতা আর বকখালিতে বিশেষ ফারাক নেই পুরুলিয়া-ঝাড়খণ্ড সীমানায়, হাইওয়ের ধারের এই ছোট্ট গ্রামের মানুষের কাছে। দু’টির একটি জায়গাও চোখে দেখেননি অধিকাংশ। কিন্তু বাউরি বাড়ির এই বউ যে এতকাল একা একা অন্য কোনও গ্রামের চায়ের দোকানে কাজ করে রোজগার করে দিন কাটিয়েছেন, তা শুনে বেশ অবাক হচ্ছেন তাঁরা।
আপাতদৃষ্টিতে গুমার ‘সতীন’ ফুলটুসির অবশ্য সে সব নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। তিনি কখনও ঝাড়খণ্ডের বাইরে যাননি। গুমার মুখে গল্প শুনে তাই ইচ্ছা হয়েছে এক বার গঙ্গাস্নানে যাওয়ার। এত বড় সংসার তাঁর। সকলের মঙ্গলের জন্য বার কয়েক গঙ্গায় ডুব দিয়ে আসা তো দরকার।
সংসার ফুলটুসিরই। গ্রামের সকলের কাছেও স্পষ্ট সে কথা। ছেলেমেয়েরাও জানেন। এত বছর নিজের হাতে আগলে রেখেছেন সকলকে। ছেলেমেয়েদের বড় করেছেন। বিয়ে দিয়েছেন। নাতি-নাতনিদের দেখভাল করছেন। এখনও করেন। শেষ দিন পর্যন্ত করবেন। বাড়িতে অতিথি এলে তিনিই যত্ন করবেন। সেই অতিথি সতীনের সঙ্গে দেখা করতে এলেই বা কী!
সতীন আসছে শুনে মন খারাপ হয়নি ফুলটুসির? তিনি সময় নেন না উত্তর দিতে। বলেন, ‘‘কেন হবেক বলুন তো? কী আছে বাড়িতে আর একটা মানুষ এলে? আমরা কি কেউ খারাপ আছি?’’ মনস্থির করে নিয়েছেন, সকলে মিলেমিশে থাকবেন। ছেলেমেয়েদের মতো গুমাকেও দেখেশুনে রাখবেন।
চৌরা গ্রামের এই বাউরি পরিবারে একসঙ্গে যে কতজন থাকেন, তা নিজেরাও গুনে ঠিক বলতে পারবেন না। উমাপদর দুই ছেলে আর পাঁচ মেয়ে। বিয়ে হয়েছে সকলের। একাধিক করে সন্তানও আছে। মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতেই থাকেন। তবে বিশেষ দূরে কাউকে যেতে দেননি ফুলটুসি। সকলকে গ্রামের আশপাশে বিয়ে দিয়েছেন। যাতে যাতায়াত লেগেই থাকে। এমনকি, উমাপদর প্রথম পক্ষের দুই মেয়ে শঙ্করী-দুলালির বিয়েও সে সব দেখেই দিয়েছেন।
গুমা বাড়ি ফেরায় দলে দলে তাঁরা দেখা করতে এসেছেন। শঙ্করীরা ফুলটুসিকেই ‘মা’ বলে ডাকেন। গুমাকে তবে কী ডাকবেন? ভারী বিপাকে পড়েছিলেন পুত্রকন্যারা। ফুলটুসিই সমাধান দিয়েছেন। মেয়ে-জামাই-ছেলে-পুত্রবধূ সকলকে বলেছেন, গুমাকে যেন তাঁরা ‘বড়মা’ বলে ডাকেন।
দাওয়ায় এসে বসেন উমাপদ। অতিথিকে নিয়ে যেন খানিক চিন্তা চোখেমুখে। গুমার কথা জানাজানি হতে বড্ড বেশি লোকজনের নজরে থাকতে হচ্ছে। ভাল লাগছে না বৃদ্ধের। তবে নিজেদের কথা বলতে ইচ্ছাও হয়। নিজেই শুরু করেন, ‘‘ভাগ্যের জোরে গুমাকে ফিরে পেলাম আমরা। একেই ভাগ্য বলে। ভাগ্যে ছিল, তাই দেখা হল। কত খুঁজেছি তখন! মেয়ে দু’টোকে নিয়ে যে কী করব! খালি চোখের জল ফেলতাম।’’
গুমা যখন হারিয়ে যান, তখন তাঁর মেয়েদের বয়স তিন এবং পাঁচ। মাতৃহারা দুই শিশুকে নিয়ে কী ভাবে সংসার চালাবেন, ভেবে এক অর্থে দিশাহারাই লাগছিল উমাপদর। ফুলটুসির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘হাল ধরেছেন ইনিই। সকলকে দেখে রেখেছেন।’’ ফুলটুসির দৃঢ় মুখশ্রীতে এ বার আবার হাসির ঝলক। মাথা নেড়ে বলেন, ‘‘ছোট ছোট ছিল গো শঙ্করী আর দুলালি। এসে কোলে তুলে নিলাম।’’ উমাপদ আবার বলেন, ‘‘প্রথমে দেড় বছর অপেক্ষা করেছি গুমার জন্য। মেয়ে দু’টো খালি মাকে খুঁজত। ফুলটুসি আসায় শান্ত হয়। বলি, এই যে তোদের মা। এঁকেই তো মা বলে বড় হয়েছে ওরা। উনিও সকলকে আগলে রেখেছেন।’’ আবেগ আর উচ্ছ্বাস সামাল দেন উমাপদ। মহিলাদের মাঝে বেশি কথা বলতে গৃহকর্তার বাধে যেন। হারানোকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ দেখে যাতে কষ্ট না পান দ্বিতীয়পক্ষ, তা নিয়ে সচেতন উমাপদ জানান, ফুলটুসির সঙ্গে প্রতি পদে আলোচনা করেছেন গুমাকে ফিরিয়ে আনার আগে।
পরিস্থিতিটা একটু গুমোট হচ্ছিল। সামাল দিলেন উমাপদর পুত্র চন্দন। স্ত্রী রিনাকে বললেন, ‘‘দিদিকে আমাদের বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাও গো।’’
আবার শুরু হয় হই হই। দোতলা বাড়ি। হাইওয়ে থেকে চৌরা গাঁয়ে ঢুকে চোখে পড়ার মতো সবচেয়ে বড়সড় বাড়িটি তো তাঁদেরই। কত যে ঘর, প্রথম বার গেলে বুঝতেই পারবে না ফ্ল্যাটবাড়িতে অভ্যস্ত শহুরে চোখ। রিনার সঙ্গে উঠে আসেন ননদ রজনী আর তাঁর বছর দশেকের কন্যা। অন্দরমহলের দোতলায় গল্প শুরু হতেই এসে যোগ দেন ফুলটুসি। কত কষ্ট করে এক একটি ঘর বানিয়েছেন, ছেলেমেয়েদের ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছেন— সব বলতে থাকেন।
অতিমারির মধ্যেই মাত্র মাস ছয়েক আগে ছোট ছেলের বিয়ে হয়েছে। ফুলটুসি বলেন, ‘‘ছ’মাস আগে এলেও ওদের বড়মা বাড়ির একটা বিয়ে দেখতে পেতেন। কিছুই তো দেখেননি তিনি। কত লোক ডেকেছি আমি ছেলেমেয়েদের বিয়েতে।’’ এর পরের উৎসব বলতে সেই বৈশাখ মাসের কালীপুজো। তখন আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হবে গুমার। বলতে থাকেন বাড়ির মহিলারা।
বৈশাখী কালীপুজোর কথা শুনেই মুখে হাসি ফোটে তত ক্ষণে নিঃশব্দে এসে আড্ডায় যোগ-দেওয়া বৃদ্ধা গুমার। ছেলেমেয়েদের বিয়ের আনন্দ কেমন হয়, তিনি জানেন না। সেখান থেকে বাদ পড়ার আক্ষেপ বিশেষ ধরা পড়ে না তাঁর চেহারায়। কিন্তু কালীপুজো ওঁর চেনা। হ্যাম রেডিয়োর সদস্যেরা গুমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন কিছু দিন ধরে। তাঁরাই খোঁজখবর নিয়ে ভিডিয়ো-কলে সেই কালীতলা দেখিয়েছিলেন। জায়গাটা দেখে এক বারেই গুমা চিনে গিয়েছিলেন—সেই গ্রামেই বাড়ি তাঁর। হ্যাম রে়ডিয়োর পশ্চিমবঙ্গ শাখার সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস বলছিলেন, ‘‘কালীতলা দেখে গুমার চোখমুখ চকচক করে উঠেছিল। আমরাও তখন বুঝতে পারি ঠিক পথেই এগোচ্ছি।’’
গুমা জানান, বকখালিতে কষ্টে ছিলেন না। কিন্তু কালীপুজোয় খুব আনন্দ হয় চৌরা গ্রামে। আবার আগের মতো উপোস করবেন বৈশাখ মাসে। ছৌ নাচ হবে। এ সব যে তাঁর আপন। এ সব ছেড়ে আর কোথাও যাবেন না। বলে দেন গুমা। বলেন, ‘‘বকখালিতে বেড়াতে যেতে পারি ক’দিনের জন্য। তবে বাড়ি ছেড়ে আর যাব না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy