মহাকুম্ভে ভিড়ের দৃশ্য। —ফাইল চিত্র।
একের পর এক ‘দেহ’, একে অন্যের গায়ের উপর পড়ে। ভাল করে দেখলে বোঝা যায়, কোনওটা যেন একটু নড়ছে, হাত নাড়ছে, ওঠার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। এক মহিলা চিত হয়ে পড়ে। শূন্যের দিকে তাঁর দৃষ্টি।
ঘটনাস্থল মহাকুম্ভ। রাত ২টো নাগাদ ঘটে গিয়েছে সেই ভয়াবহ ঘটনা। ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন বহু মানুষ। গুরুতর জখম অবস্থায় অনেকে হাসপাতালে ভর্তি। চোখের নিমেষে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়েছে সেই সব আতঙ্ক-দৃশ্য। অথচ এর কয়েক ঘণ্টা পরেই কুম্ভ যেন সেই পুরনো চেহারায়! স্নানের ঘাটে ভিড়। মানুষ ব্যস্ত পুণ্যস্নানে, তৃপ্তি চোখেমুখে।
পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনার পরে আখড়াগুলো মৌনী অমাবস্যার অমৃত স্নান বাতিল ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সে সব উপেক্ষা করেই সাধারণ পুণ্যার্থীরা কুম্ভস্নান করেছেন। তাঁদের স্নানের উৎসাহে কোনও ঘাটতি ছিল না। কারও মুখে কোনও আশঙ্কাও দেখতে পেলাম না।
আমরা আজ যখন দুপুর ২টো-আড়াইটে নাগাদ সঙ্গম থেকে ফিরে আসছি, তখনও স্নান চলছে। ছোট্ট একটা জায়গা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, যেটা দৈর্ঘ্যে বেশি কিন্তু প্রস্থে অপরিসর। সেখানে কোমরের কাছাকাছি জল, তাই মাথা ডুবিয়ে স্নান করা কঠিন। জল বেশ অপরিষ্কার, কাদা, ফুল-মালা ইত্যাদি ভাসছে। আগের দিন সরকার নিযুক্ত যে সাফাই বাহিনী দেখা গিয়েছিল, তাদের আজ অতটাও দেখতে পাওয়া যায়নি। হয়তো ভিড় বেশি ছিল বলে তাঁরা সে ভাবে কাজ করতে পারেননি। এর মধ্যে মানুষ যেখানে সেখানে প্লাস্টিক ফেলে রাখছেন। তার পর সেই প্লাস্টিকে জল পড়ে পিছল হয়ে থাকছে। অনেকেই পা হড়কে পড়ে যাচ্ছেন।
স্নানের ঘাটের কাছে অনেকে মাটির ভাঁড় ভাঙছেন। তার ভাঙা টুকরো পায়ে এসে বিঁধছে। সে সবেও নিরুত্তাপ সাধারণ মানুষ।
পুণ্যার্থীদের সুবিধার জন্য যমুনার উপর ৩০ খানা অস্থায়ী পুল তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর বেশির ভাগই বন্ধ ছিল কাল। আজ মনে হয় সবই বন্ধ। গত কাল রাতে আটটি (১৩, ১৫, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২) পুল খোলা ছিল। বাকি সব বন্ধ ছিল। ভিড় যখন বাড়ছে, তখন পুল বন্ধ করে দেওয়ার কারণটা স্পষ্ট নয়। পুলিশের কাছেও স্পষ্ট তথ্য নেই। ডিজিটাল বোর্ডে এক দেখানো হচ্ছে, পুলিশ অন্য তথ্য দিচ্ছে। সাংবাদিক পরিচয় দিলেও তেমন সাহায্য মিলছে না।
আমরাও কুম্ভস্নানে করেছি, তবে এক দিন আগে। গত কাল যখন শাস্ত্রী ব্রিজের দিক থেকে গিয়ে কুম্ভমেলার আখড়াগুলোর কাছে পৌঁছই (অর্থাৎ সেক্টর ১৯-২০-তে), তখন সেখানে দেখি লোকজন শাহি স্নানের জন্য সঙ্গমের দিকে যাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। আখড়ায় মানুষ বসে খাবার খাচ্ছিলেন, শীতের পোশাক, জল বিলি করা হচ্ছিল। মেলা প্রাঙ্গণে সবের ব্যবস্থাই রয়েছে। ভিড় দেখে তখনও মনে হয়নি, এত বড় বিপদ ঘটে যেতে পারে।
পুলিশকে জিজ্ঞাসা করছি, কত মানুষ আহত, ঠিক কী অবস্থা তাঁদের, কিছুই কেউ বলতে চাইছেন না। এ দিকে একের পর এক শিউরে ওঠা দৃশ্য। অ্যাম্বুল্যান্সে বসে বৃদ্ধা মা কেঁদেই চলেছেন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। সাড় নেই ছেলের। বৃদ্ধা বলছেন, ‘‘মেরে লাল... মেরে লাল...।’’
কর্নাটক থেকে আসা সরোজিনী বললেন, ‘‘আমাদের ৬০ জনের একটি দল, দুটো বাসে করে এসেছি। আমরা ৯ জন একসঙ্গে ছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। আমরা মাঝখানে পড়ে যাই। চাপ সামলাতে না পেরে অনেকেই পড়ে যান। ওখান থেকে পালানোরও পথ ছিল না। চারদিক থেকে ধাক্কা লাগছিল।’’ আর এক মহিলাও একই কথা বলেছেন। তাঁর বাচ্চা ওই ঘটনায় জখম হয়েছে। হাসপাতালে বসে বলেছেন, ‘‘কোনও দিকে যাওয়ার উপায় ছিল না। কিছু লোকজন হাসাহাসি করছিল আর ধাক্কা মারছিল। আমরা বলি, সঙ্গে বাচ্চা রয়েছে, এ ভাবে ঠেলবেন না।’’
আজ দুপুরবেলার পর থেকে ভিড়ের বেশিটাই স্টেশনমুখী ছিল। সঙ্গম তুলনায় ফাঁকা। মানুষের ঢলের ৭০ শতাংশ স্টেশনের দিকে, বাকিরা যাচ্ছেন সঙ্গমের দিকে। সেখানে (সেক্টর ৩-এর কাছে) তখনও পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনার চিহ্ন স্পষ্ট। চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে জামা, জুতো, কম্বল, পিঠের ব্যাগ। লোকজনের ভ্রূক্ষেপ নেই। ও সবের উপর দিয়েই হেঁটে যাচ্ছেন তাঁরা সঙ্গমের দিকে, পুণ্যস্নান করতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy