প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
মোদী সরকারের ন’বছরে দেশে ধনী-গরিবের মধ্যে আর্থিক অসাম্য অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে বলে দাবি করল ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব’। প্যারিস স্কুল অব ইকনমিক্সের এই প্রতিষ্ঠানে গবেষণারত প্রথম সারির অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্রিটিশ জমানার থেকেও এখন ভারতে আর্থিক অসাম্য বেশি।
শুধু তা-ই নয়। ভারতে এখন ‘আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণি’র নেতৃত্বে ‘ধনকুবেরদের রাজত্ব’ বা ‘বিলিয়নেয়ার রাজ’ চলছে বলে একটি রিপোর্টে দাবি করেছেন টমাস পিকেটি-সহ ওই অর্থনীতিবিদেরা। তাঁদের আশঙ্কা, এর ফলে ভারতে ধীরে ধীরে ধনীদের শাসন বা ‘ধনিকতন্ত্র’ বা ‘প্লুটোক্রেসি’ কায়েম হতে পারে।
‘ভারতের আর্থিক অসাম্য: ধনকুবেরদের রাজত্বে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজত্বের থেকেও বেশি অসাম্য’ শীর্ষক ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২-২৩ সালে ভারতের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশই ধনীতম ১ শতাংশ ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত ছিল। দেশের মোট আয়ে তাঁদের ভাগ ২২ শতাংশের বেশি। আমেরিকা, ব্রাজ়িল, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশেও জাতীয় আয়ে ধনীতমদের ভাগ এত বেশি নয়। আয়ের দিক থেকে শেষ সারির ৫০ শতাংশ বা দেশের অর্ধেক মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ। অথচ বিত্তের বিচারে একেবারে উপরের ১ শতাংশ মানুষের গড় আয় বছরে ৫৩ লক্ষ টাকা। গড়পরতা ভারতীয়ের আয়ের ২৩ গুণ। সেখানে নীচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের গড় আয় মাত্র ৭১ হাজার টাকা। আর মাঝের সারির ৪০ শতাংশ মানুষের গড় আয় ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। আবার সব থেকে ধনী ১০ হাজার ব্যক্তির গড় আয় বছরে ৪৮ কোটি টাকা। গড়পরতা মানুষের আয়ের দু’হাজার গুণেরও বেশি!
এর আগেও অক্সফ্যাম-এর মতো সংস্থা কোভিডের পরে কী ভাবে ভারতে ধনী-গরিবের ফারাক বেড়েছে, কী ভাবে ধনীরা আরও ধনী, গরিবরা আরও গরিব হয়েছেন, তা নিয়ে রিপোর্ট দিয়েছে। এখন লোকসভা নির্বাচনের আগে ধনী-গরিবের অসাম্য নিয়ে এই নতুন আন্তর্জাতিক রিপোর্ট সামনে আসায় মোদী সরকার অস্বস্তিতে পড়েছে। উল্টো দিকে বিরোধীরা অস্ত্র পেয়ে গিয়েছেন।
কংগ্রেসের বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় কোটিপতিরা রাজত্ব চালাচ্ছেন। তাঁরা মোদীর দলের প্রচারের পিছনে অর্থ খরচ করছে। মোদী সরকারের দশ বছর যে অন্যায়ের কাল, তা এখন স্পষ্ট। তাদের অভিযোগ, মোদী সরকারের নীতিই হল, ধনীদের আরও ধনী করে তোলা, আর গরিবদের আরও গরিব। ও এই সমস্ত তথ্য-পরিসংখ্যান লুকিয়ে রাখা। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির বক্তব্য, ‘‘এক দিকে কর্পোরেট সংস্থার মদত, অন্য দিকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ—দু’য়ের মিশেলে লুট চলছে। হাল বদলাতে হলে মোদী সরকারকে হারাতে হবে।’’ মোদী সরকার বা কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রক সূত্রে অবশ্য দাবি, পুরো রিপোর্ট খতিয়ে দেখে এর জবাব দেওয়া হবে।
প্যারিস স্কুল অব ইকনমিক্সের ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবে দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনীতিবিদেরা সারা বিশ্বের আর্থিক অসাম্য নিয়ে গবেষণা করছেন। ভারতের আর্থিক অসাম্য নিয়ে গবেষণাপত্রটি লিখেছেন প্যারিস স্কুল অব ইকনমিক্সের টমাস পিকেটি, আনমোল সোমাঞ্চি, নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিতিন কুমার ভারতী ও হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের লুকাস চ্যানসেল। তাঁদের বক্তব্য, ২০১৪-১৫ (অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময়ে) থেকে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে অসাম্য চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দল প্রায়শই দেশের যাবতীয় সমস্যার জন্য জওহরলাল নেহরুকে দায়ী করলেও, অর্থনীতিবিদদের গবেষণাপত্র বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশকের গোড়া পর্যন্ত অসাম্য কমেছিল। তার পরে তা বাড়তে শুরু করে। চলতি শতকের গোড়া থেকে তা রকেটের গতিতে বেড়েছে। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে চূড়ায় পৌছেছে। দেশের মোট আয়ে ধনীতম ১ শতাংশ ব্যক্তির ভাগ ২২.৬ শতাংশ আর দেশের মোট সম্পদে তাঁদের ভাগ ৪০.১ শতাংশ।
কেন বাড়ছে এই অসাম্য? অর্থনীতিবিদেরা জানাচ্ছেন, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধির ফারাক একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। কিন্তু তার পরে মূলধন বা পুঁজি থেকে আয় বড় ভূমিকা নিয়েছে বলে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে। নীচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষ ও মাঝের সারির ৪০ শতাংশ মানুষ দমিত থেকে গিয়েছেন। কারণ, সকলের জন্য উঁচু মানের শিক্ষার ব্যবস্থা হয়নি। জনগণের দিকে নজর দেওয়ার বদলে ‘এলিট’ বা সমাজের উপরের সারির মানুষের দিকে নজর থেকেছে। ভারতের কর ব্যবস্থাও গরিবদের উপরে বেশি বোঝা চাপিয়ে থাকে বলে তাঁদের পর্যবেক্ষণ।এর ফল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁদের বক্তব্য, এই চূ়ড়ান্ত অসাম্যের ফলে সমাজ ও সরকারের উপরে প্রভাব পড়বে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্বল হয়ে পড়বে। বিরোধী শিবির বহুদিন ধরেই অভিযোগ তুলছে, মোদী জমানায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি নিরপেক্ষ না থেকে মোদী সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদরাও বলেছেন, ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে এই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিই ‘রোল মডেল’ ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেদের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে আপস করেছে। এর ফলে ভারতের ‘প্লুটোক্রেসি’র দিকে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আরও প্রবল হয়ে উঠেছে। শুধু এই কারণেই ভারতের আর্থিক অসাম্যের দিকে আরও নজর দেওয়া দরকার বলে তাঁদজের অভিমত।সমাধান হিসেবে অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, ১৬৭টি ধনীতম পরিবারের উপরে ২ শতাংশ সম্পদ কর বসানো হোক। তাতে যে সরকারি আয় হবে, তা কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টিতে সকলের জন্য সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হোক। যাতে বিশ্বায়নের সুফল সকলে নিতে পারেন।কংগ্রেসের অবশ্য অভিযোগ, মোদী সরকারের আর্থিক নীতি প্রথম থেকেই শুধু তাঁর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের জন্য তৈরি হয়েছে। উল্টো দিকে আদানি গোষ্ঠী-সহ পাঁচটি বড় সংস্থা মিলে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধির সমস্যায় মানুষকে জেরবার করে তুলেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে বেকারত্ব। এই পরিস্থিতি ধামাচাপা দিয়ে রাখতেই মোদী সরকার জনগণনা, আর্থ-সামাজিক জাতগণনা করায়নি। গ্রামীণ আয় কমে যাওয়ার পরিসংখ্যানও ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy