Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
National News

‘টেম্পো এসেছে, তার মানে রুটি মিলবে এ বার!’

দিল্লির সাম্প্রতিক সংঘর্ষে সব খুইয়ে এ বার ৮ মার্চ তাঁদের ঠিকানা মুস্তাফাবাদের ত্রাণ শিবির। যে দিন সাড়ম্বরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন হবে।

মুস্তাফাবাদের ত্রাণ শিবিরে মহম্মদ দিলশাদ। —নিজস্ব চিত্র

মুস্তাফাবাদের ত্রাণ শিবিরে মহম্মদ দিলশাদ। —নিজস্ব চিত্র

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০ ০৪:২২
Share: Save:

দু’দশক আগে উত্তরপ্রদেশের মেরঠের কাছে ধোল্ডি গ্রাম থেকে জীবিকার খোঁজে দিল্লি এসেছিলেন রেহানা বেগমের স্বামী। তাঁর হাত ধরে নতুন বিয়ে হওয়া রেহানা। দিল্লির সাম্প্রতিক সংঘর্ষে সব খুইয়ে এ বার ৮ মার্চ তাঁদের ঠিকানা মুস্তাফাবাদের ত্রাণ শিবির। যে দিন সাড়ম্বরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন হবে। আর ‘প্রেরণাদাত্রী’ মহিলাদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ছেড়ে দেবেন নরেন্দ্র মোদী!

আজ মুস্তাফাবাদের ইদগায় তৈরি অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে পৌঁছে দেখা গেল, ভিতরে আগের দিনের মতো জল থইথই দশা আর নেই। কিন্তু বাইরের এবড়োখেবড়ো রাস্তায় ঘোলা জল আর প্যাচপ্যাচে কাদা। টানা জল জুগিয়েও পুরুষ ও মহিলাদের অস্থায়ী শৌচাগার পরিষ্কার রাখতে হিমশিম স্বেচ্ছাসেবকরা। মহম্মদ ইদ্রিশ বলছিলেন, ‘‘এ তল্লাটে এত লোকের ঘর গিয়েছে যে, দিনে এখানে রয়েছেন অন্তত হাজার দেড়েক লোক। তাঁদের দেখতে আসছেন আত্মীয়স্বজন। এত জনের বন্দোবস্ত এ টুকু জায়গায় কী ভাবে করা যায় বলুন তো?’’

আর রাতে? হায়দর বললেন, ‘‘রাতে এখানে থাকছেন মেরেকেটে পাঁচ-ছ’শো জন। বাকিরা চলে যাচ্ছেন আশপাশের আত্মীয়ের বাড়ি। এখনও মনের মধ্যে চেপে বসে আছে ভয়— যদি ফের ঘিরে ধরে হামলা হয়?’’

ইদগায় (নমাজ পড়ার জায়গা) এবং চার পাশে মুসলিম মহল্লা। নিরাপত্তা তুলনায় বেশি বলেই এখানে ত্রাণ শিবির। এক দিকে লাগালাগি বিছানায় পুরুষেরা। ভিতরে ত্রিপল আর শতরঞ্চির পর্দার আড়ালে থাকার জায়গা মহিলাদের।

আরও পড়ুন: ‘প্রধানমন্ত্রীর কথা আমার চেয়ে ভাল আর কে জানেন?’

কোথাও এফআইআর লিখছেন উকিল। কোথাও ওষুধের কাউন্টার খুলেছে অ-সরকারি সংস্থা। তারই মধ্যে মাইকে ঘোষণা হল, আটার বস্তা এসেছে। টেম্পো থেকে নামিয়ে ভিতরে বয়ে আনার লোক চাই। জনা কয়েক তরুণ ছুটলেন। আর ডাঁই করে রাখা অব্যবহৃত ফোল্ডিং খাটে হেলান দিয়ে এক মধ্যবয়সিনী পাশের জনকে বললেন, ‘‘তার মানে, রুটি মিলবে।’’

এ দিন যত কথা অবশ্য নিজেদের মধ্যেই। এখানে ঘুরে গিয়ে কোন সংবাদমাধ্যম না কি প্রচার করেছে যে, এই শিবির আসলে শাহিন বাগের মতোই ‘জঙ্গি তৈরির আখড়া’। একে হিংসা সব কেড়েছে। তার উপরে এই প্রচারে শিবিরের লোক এতটাই চটেছেন যে, সংবাদমাধ্যম শুনলেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা।

বিস্তর চেষ্টায় বরফ যখন গলল, তখন বোঝা গেল সংঘর্ষের ক্ষত তাঁদের শরীরে যত না দগদগে, তার থেকেও সম্ভবত টাটকা মনে। মুস্তাফাবাদ লাগোয়া শিব বিহারের বাসিন্দা রেহানা বলছিলেন, যে দোতলা বাড়িতে তাঁরা ভাড়া থাকতেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ কী ভাবে তা পুড়ে ছাই হল। তাঁর দুই ছেলে দশম আর একাদশ শ্রেণির ছাত্র। পুড়ে ছাই তাদের সমস্ত বইও। প্রাণ বেঁচেছে পাশের হিন্দু পরিবার মই লাগিয়ে নামিয়ে এনে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল বলে। রেহানার কথায়, ‘‘পণ্ডিতজি প্রাণ বাঁচিয়েছেন। বহু বার ডেকেও পুলিশ আসেনি। রাত একটা নাগাদ বেরিয়েছি আধা সেনার পাহারায়।’’

শুধু পুলিশ কেন, আসেনি অ্যাম্বুল্যান্সও। মাথায় ৪০টি সেলাই নিয়ে ২৩ বছরের ইমরান বলছেন, ‘‘কাজ থেকে ফেরার পথে মাঝ রাস্তায় লাঠি আর রডের বেদম মার। সঙ্গে খুরপির কোপ। জ্ঞান হারিয়ে ঘণ্টা দু’য়েক পাশের নালায় পড়েছিলাম। জ্ঞান ফেরার পরে দেখলাম, গলায় গড়ির ফাঁস। রক্ত ঝরছে অঝোরে। তার পরেও দেড় দিন মাথায় কাপড় জড়িয়ে বাড়িতে। অ্যাম্বুল্যান্স না-আসতে পারলে হাসপাতালে যাব কী করে?’’

২৪ তারিখের আক্রমণে মহম্মদ দিলশাদের বাঁ হাত ভেঙে দু’টুকরো। তাতে মোটা প্লাস্টার। রডের আঘাতে থেঁতলে গিয়েছে মাথাও। ম্লান হেসে বললেন, ‘‘জিজ্ঞাসা করবেন না যে, এখানে সব ঠিকঠাক পাচ্ছি কি না। প্রাণে বেঁচে আছি, এই ঢের।’’

কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, সব ওষুধ নেই। ক্ষতিপূরণের হিসেব কষতে সরকারি অফিসার এসেছেন শুনে অনেকে দৌড়চ্ছেন। আবার কেউ মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন বিরক্তিতে। বলছেন, ‘‘কত দেবে জানা আছে।’’ ত্রাণ শিবিরের মুখে পুলিশের পাহারা দেখে জিজ্ঞাসা করছেন, সংঘর্ষের দু’তিন দিন এঁরা ছিলেন কোথায়?

তারই মধ্যে এক জায়গায় ডাঁই করা ফোমের মোটা চাদরে লাফাচ্ছে এক দল কচিকাঁচা।

কেউ বাড়ি হারিয়েছে, কেউ বাবা!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy