Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

টানা ১২ ঘণ্টা খেটে ছাদেই ঘুমোচ্ছিলেন ওঁরা, ঘুম ভাঙল মৃত্যুর সামনে

‘‘এই যে, এই দুটো নাম দেখুন। কোথায় খুঁজে পাব এদের?  গাঁ থেকে ফোন আসছে বারবার। হাসপাতাল ঘুরে এসেছি কিন্তু সুবিধা করতে পারছি না।’’

স্বজনের মৃত্যুতে ভেঙেে পড়ছেন। ছবি সৌজন্য টুইটার।

স্বজনের মৃত্যুতে ভেঙেে পড়ছেন। ছবি সৌজন্য টুইটার।

অগ্নি রায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৪:৫৪
Share: Save:

রানি ঝাঁসি রোডে ধারের পাঁজর বার করা ফিল্মিস্তান সিনেমা হল ঘিরে সাম্প্রতিক অতীতে এমন মানুষ থই থই করেনি। সামনেই পুলিশের ব্যারিকেড। আগুন সবে আয়ত্তে এসেছে। চামড়া-পোড়া গন্ধ এবং সমবেত আতঙ্কের কাছে আয়ত্ত কেন, কোনও শব্দই দাঁড়াতে পারবে না।

‘‘এই যে, এই দুটো নাম দেখুন। কোথায় খুঁজে পাব এদের? গাঁ থেকে ফোন আসছে বারবার। হাসপাতাল ঘুরে এসেছি কিন্তু সুবিধা করতে পারছি না।’’ রবিবার সকালে প্রবল হট্টগোলের মধ্যে ধাক্কা খেতে খেতে যে প্রৌঢ়ের সামনে পৌঁছেছি, তাঁর হাতে বহু ভাঁজ করা ময়লা কাগজে দু’টি নাম লেখা। মহম্মদ মোবারক, মহম্মদ গিয়াস। এঁরাও অন্য শ্রমিকদের মতো চামড়ার রোল ভ্যান থেকে নামিয়ে কারখানায় ঢুকিয়ে শান্তির নিদ্রায় গিয়েছিলেন কনকনে ভোরে। তেতলার উপরে ছাদের ঘরে। গোটা কারখানা তথা গলি কালো ধোঁয়া ঘিরে নেওয়ার পর দুই যুবক প্রাণ বাঁচাতে পেরেছেন কি না, জানা নেই।

ইদের পর বিহারের সহর্ষ জেলা থেকে দিল্লি এসে এই কারখানায় কাজে ঢোকেন এই দুই যুবক। ‘‘এ শহরে ওদের চেনা বলতে একমাত্র আমিই। এক গ্রামের লোক। থাকি নয়ডায়। নানা জিনিস ফিরি করি। সকালে ওদের বাবার ফোন পেয়ে ছুটে এসেছি।’’ বলছেন অস্থিচর্মসার প্রৌঢ়— যাঁর নাম মহম্মদ সাজাদ।

আরও পড়ুন: বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিল পেশ আজ লোকসভায়

জতুগৃহের সামনে পুলিশের প্রাচীর। বাইরে রাস্তা জুড়ে শোক, আতঙ্ক, উত্তেজনার ছোট ছোট বৃত্ত। দিল্লি পুলিশ, স্থানীয় মাতব্বর, মাঝারি সরকারি বাবু এবং ছোটখাটো নেতাদের হুড়োহুড়ি। পুরনো দিল্লির সদরবাজারের এই নিউ আজাদ মান্ডির নাগরিক সুরক্ষা কমিটির প্রধান অর্জুন কুমার তেমনই একটি বৃত্তের মাঝে দাঁড়িয়ে সকাল থেকে অনর্গল

কথা বলে চলেছেন। ‘‘প্রায় সব শ্রমিকই ভিনরাজ্য থেকে এসেছেন। থাকার পাকা জায়গা নেই। চামড়ার ব্যাগের পিস যত বেশি বানাতে পারবে, ততটাই বাড়বে এঁদের আয়। ওভারটাইমে দুটো টাকা বেশি আসে বলে ১২ ঘণ্টা টানা কাজ করে ওই কারখানার ছাদের ঘরেই মরার মতো ঘুমোয়।’’

আরও পড়ুন: উপহার সিনেমা হলের স্মৃতি ফিরল দিল্লিতে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৪৩ জনের মৃত্যু

এলাকার নাম নিউ আজাদ মান্ডি, কারণ, আগে তা ছিল পাইকারি আনাজ বাজার। তখনই এই এলাকা ব্যবসা-বাণিজ্য করার অনুমতি পায়। কালক্রমে গড়ে ওঠে চামড়ার কারখানা। যার গায়ে গায়ে অসংখ্য দোকান, সেলুন, সর্বোপরি বসতবাড়িও। অর্জুন কুমার বলছেন, ‘‘যে রকম বেআইনি ভাবে বাড়ি তোলা হয়েছে, তাতে এক-একটা মিটার বক্সে প্রবল চাপ পড়ছে। শর্ট সার্কিট যে আগে কেন হয়নি, এটাই আশ্চর্যের।’’

ভোরবেলা ওই ধোঁয়া থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মাসুদ আজমলকে। তখনও দমকল ওই সরু গলিতে ঢুকতে পারেনি (প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী, দমকল আসার আগেই বেশ কয়েক জনকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়েছে অটোয়)। প্রাথমিক চিকিৎসার পর শারীরিক ভাবে সুস্থ হয়েছেন তিনি। তবে চোখ
এখনও ঘোলা। পায়ে পায়ে ফিরে এসে বসেছেন ফিল্মিস্তানের সিঁড়িতে। এর আগে তাঁকে সেখানে যেতে
দেয়নি পুলিশ।

বিহারের চম্পারণ থেকে বছরখানেক আগে দিল্লি এসে এই কারখানাটা ছিল মাসুদের বাড়ি ও জীবিকা। ধোঁয়ায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়া মাসুদের এখন একমাত্র চিন্তা, নিজের ও তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা সুদূর বিহারের গাঁয়ের কিছু মানুষের পেট নিয়ে। আর পোড়া চামড়ার গন্ধ ও পাঁশুটে ধোঁয়ার পাশাপাশি চোরা রাজনীতি, পারস্পরিক দোষারোপ, অনির্দিষ্টকালের জন্য তালা ঝোলার সম্ভাবনা ভাসছে গোটা এলাকার বাতাসে।

মাসুদের মতো যাঁরা কোনওমতে বেঁচে ফিরছেন, তাঁদের পেট চালানোর লড়াইটা, আগামিকাল সকাল থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Delhi Fire Delhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy