আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র
দুই সরকারের দ্বন্দ্বে আখেরে জাঁতাকলে আমলারা। যে ভাবে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মুখ্যসচিব পর্যায়ের আমলাকে কর্মজীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে হেনস্থার শিকার হতে হল তাতে রীতিমতো আতঙ্কিত আমলাকুল। মনে প্রশ্ন, আগামী দিন কার নির্দেশ মানা উচিত হবে? কেন্দ্র না রাজ্যের! প্রধানমন্ত্রীর না মুখ্যমন্ত্রীর!
মূলত আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে টানাটানির ঘটনা আলোড়ন ফেলেছে গোটা দেশেই। বিজেপি-বিরোধী দলগুলি ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ত্রস্ত আমলাকুলও। আইএএস ও আইপিএস ক্যাডারেরা কেন্দ্রের অফিসার হলেও, তাঁরা যখন রাজ্যে নিযুক্ত থাকেন তখন তাঁরা রাজ্যের অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকেন। তাঁদের সরাসরি নির্দেশ দেওয়ার অধিকার থাকে কেবল রাজ্যের। কিন্তু কর্মিবর্গ মন্ত্রকের মতে, আলাপনবাবুর ক্ষেত্রে সমস্যা হল এ ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মানতে গিয়ে তিনি অনিচ্ছাকৃত ভাবে চটিয়ে ফেলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই ‘বস’-এর মর্যাদার লড়াইয়ের শিকার হয়েছেন তিনি। সরাসরি বিষয়টির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জড়িয়ে থাকায় আইএএস অ্যাসোসিয়েশন এ নিয়ে এখন পর্যন্ত নীরব থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও, দিল্লির আমলা শিবিরের একটি বড় অংশের সমর্থন আলাপনবাবুর দিকেই।
আলাপনবাবুর বিরুদ্ধে কেন্দ্রের অভিযোগ কেন সে দিন প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে দেরিতে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি? এবং কেন তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ছেড়ে চলে যান? মুখ্যমন্ত্রী চলে গেলেও আলাপনবাবুর উচিত ছিল বৈঠকে উপস্থিত থাকা।
দীর্ঘদিন রাজ্যে কাজ করে বর্তমানে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে থাকা এক অতিরিক্ত সচিবের কথায়, ‘‘যখন আমলারা রাজ্যে নিযুক্ত থাকেন তখন তাঁদের বস হলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি যা বলবেন তা শুনতে বাধ্য সেই আমলা। না হলে সেই আমলার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ উঠতে পারে। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যসচিবকে তাঁর সঙ্গে দিঘা যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। মুখ্যসচিব সেই নির্দেশ মানতে বাধ্য। তাই তিনি প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে উপস্থিত না থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে চলে যান।’’ ওই অতিরিক্ত সচিবের মতে, আলাপনবাবুর এতে কোনও দোষ রয়েছে বলে মনে হয় না। তিনি কেবল তাঁর প্রশাসনিক ‘বসে’র নির্দেশ পালন করছিলেন মাত্র। যদিও ভিন্ন মতও রয়েছে। আমলাদের একাংশের বক্তব্য, খোদ মুখ্যমন্ত্রী যখন ওই বৈঠকে থাকতে পারবেন না তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচিত ছিল সৌজন্যের খাতিরে আলাপনবাবুকে সেই বৈঠকে থাকতে বলা। গত সাত বছরে কেন্দ্রের ডাকা মুখ্যমন্ত্রীদের একাধিক বৈঠকে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওই বৈঠকগুলিতে রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে মুখ্যসচিব তাতে উপস্থিত ছিলেন। এ যাত্রাতে তাই করলে জল এত ঘোলা হত না বলেই মত ওই আমলা শিবিরের। তবে উভয় শিবিরের মত, আলাপনবাবু যা করেছেন তা তাঁর উপরওয়ালার নির্দেশেই করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর কিছু করার ছিল না। ফলে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে আগামী দিনে কার কথা শোনা উচিত তা নিয়ে রীতিমতো সংশয় তৈরি হয়েছে আমলা শিবিরে। যুগ্মসচিব পর্যায়ের এক আমলার কথায়, ‘‘আমাদের সার্ভিস রুল এমন যে রাজ্যে নিয়োগ হলেও কেন্দ্রেরও অধিকার থেকে যায়। ফলে এই ধরনের পরিস্থিতি আগামী দিনে তৈরি হলে কার কথা শোনা উচিত তা নিয়ে প্রবল সংশয় দেখা দিয়েছে।’’ আশঙ্কা, আলাপনবাবুকে দিয়ে শুরু হওয়া যুদ্ধ আগামী দিনেও চলবে। আগামী দিনে আমলাদের উপরে হস্তক্ষেপ আরও বাড়বে কেন্দ্রের।
তবে অতীতেও বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্র-রাজ্যের মর্যাদার লড়াইয়ে বলি হয়েছেন আমলারা। নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সোহরাবুদ্দিন মামলায় অমিত শাহের দিকে আঙুল তুলেছিলেন তদন্তকারী অফিসার কুলদীপ শর্মা। শুরু হয় সমস্যা। শেষে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে কুলদীপ সেন্ট্রাল ডেপুটেশন নিয়ে দিল্লিতে চলে আসেন। তৎকালীন ইউপিএ সরকার ২০১৩ সালে কুলদীপকে বুরো অব পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সংস্থার ডিজি পদে নিয়োগ করলে তা নিয়ে আপত্তি তোলে গুজরাত সরকার। দিল্লি হাই কোর্টে মামলা হলে অবশ্য সেই মামলায় হেরে যায় গুজরাত সরকার। পরে কুলদীপের অবসরের পরে তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ করে মনমোহন সরকার। ফলে আমলাদের নিয়োগকে কেন্দ্র করে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদ নতুন নয়। অতীতে তামিল এক অফিসারের নিয়োগ ঘিরেও এ ভাবে আইনি বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল কেন্দ্র ও তামিলনাড়ু সরকার। আমলাদের মতে, আইপিএস অফিসার রাজীব কুমারের পরে আলাপনবাবুকে ঘিরে বিবাদ কেন্দ্র-রাজ্য বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করল মাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy