গত শুক্রবারের বুথফেরত সমীক্ষা মধ্যপ্রদেশে গেরুয়া ঝড়ের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিল। ছবি: পিটিআই।
এ ভাবেও ফিরে আসা যায়!
দু’মাস আগেও মধ্যপ্রদেশে প্রবল প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়ার ধাক্কায় জেরবার ছিল বিজেপি শিবির। পরিস্থিতি সামলাতে এক দিকে তখন নামানো হচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতাদের, অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান আদৌ টিকিট পাবেন কি না, তা নিয়ে প্রবল অনিশ্চয়তা। শাসক দলের ওই ডামাডোল দেখে প্রতিপক্ষ কংগ্রেস নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছিলেন, এ যাত্রায় গো-বলয়ের অন্যতম বড় রাজ্য মধ্যপ্রদেশ বিজেপির হাতছাড়া হওয়া নিশ্চিত। কিন্তু সব হিসেব উল্টে দিয়েছে ভোটের ফলাফল। দু’দশক আগে ২০০৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় এ বারে আসনপ্রাপ্তি সামান্য কম হলেও, ভোট প্রাপ্তির শতকরা হিসাবে এ যাত্রায় ওই রাজ্যে সেরা ফল করেছে বিজেপি।
গত শুক্রবারের বুথফেরত সমীক্ষা মধ্যপ্রদেশে গেরুয়া ঝড়ের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সেটা যে সুনামি হয়ে আছড়ে পড়তে চলেছে, বিজেপির অতি বড় সমর্থকও সম্ভবত ভাবতে পারেননি। ওই রাজ্যের ২৩০টি আসনের মধ্যে দিনের শেষে বিজেপি পেয়েছে ১৬৩টি আসন। গত বারের চেয়ে ৫৪টি বেশি। মোট ভোটের প্রায় ৪৯ শতাংশ। যা ২০০৩
সালের চেয়ে প্রায় পাঁচ শতাংশ বেশি। অন্য দিকে কংগ্রেস ভোট পেয়েছে প্রায় ৪১ শতাংশের কাছাকাছি। আট শতাংশের ওই ভোটের পার্থক্যে কংগ্রেসের চেয়ে ৯৭টি আসন বেশি জিতেছে বিজেপি।
যে মধ্যপ্রদেশে পরাজয় নিশ্চিত বলে কার্যত ধরেই নিয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্বের বড় অংশ, সেখানে এমন ম্যাজিক কী ভাবে সম্ভব হল? প্রাথমিক বিশ্লেষণে যে সব কারণ উঠে এসেছে, তাতে প্রথমেই দেখা যাচ্ছে মহিলা সমাজের ঢালাও সমর্থন বিজেপি পেয়েছে। আর এই সমর্থনের পিছনে রয়েছে তথাকথিত রেউড়ি সংস্কৃতি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিরোধী রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে খয়রাতি বা পাইয়ে দেওয়ার নীতির প্রবল সমালোচনা করলেও কার্যক্ষেত্রে বিজেপির ভোট বৈতরণী পার করেছে সেই হাতে নগদের ঘোষণাই।
চার মাস আগে দলের পরিস্থিতি বেকায়দায় দেখে পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ্মীর ভান্ডারের ধাঁচে ‘লাডলি বহেনা’ যোজনা শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ। প্রথম দু’মাসে হাজার ও পরের দু’মাসে মহিলাদের হাতে হাতে পৌঁছে যায় ১২৫০ টাকা করে। সঙ্গে প্রতিশ্রুতি, জিতলে ওই টাকা বাড়িয়ে ৩ হাজার করা হবে। বিজেপি নেতারা মনে করছেন, শেষ সময়ে খেলা ঘুরিয়েছে ওই প্রকল্পই। যে কারণে মধ্যপ্রদেশের অর্ধেক আকাশ একজোট হয়ে বিজেপির পক্ষে ভোট দিয়েছে। ওই যোজনার কল্যাণে মসনদ দখল নিশ্চিত করে শিবরাজ নিজের রাজনৈতিক জীবনের অস্তিত্বই কেবল বাঁচালেন না, পঞ্চম বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দাবিদার হিসাবে একেবারে প্রথম সারিতে উঠে এলেন।
রাজ্যে প্রধান প্রতিপক্ষ তথা কংগ্রেসের মূল নেতা ছিলেন কমলনাথ। তিনি গোড়া থেকেই ওই রাজ্যে কোনও কেন্দ্রীয় নেতাকে সে ভাবে এগিয়ে খেলার জমি দেননি। উল্টে বার্তা দিয়েছিলেন, রাজ্যে বিজেপিকে হটাতে তিনি একাই যথেষ্ট। গোড়া থেকেই কমলনাথের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব ভাল ভাবে দেখেননি অনেক কংগ্রেস নেতাই। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আস্থাভাজন হওয়ায় অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা হয়নি। অন্য দিকে শিবরাজের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার গন্ধ পেতেই কৌশল বদলে ফেলে বিজেপি। ভোট ময়দানে প্রার্থী হিসাবে দিমানী কেন্দ্র থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমরকে। এ ছাড়া নরসিংহপুর থেকে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী প্রহ্লাদ সিংহ পটেল, গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী ফগন সিংহ কুলস্থ দাঁড়ান নিওয়াস কেন্দ্র থেকে। কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় টিকিট পান ইন্দোর (১) কেন্দ্র থেকে। ওই চার জন ছাড়াও আরও চার সাংসদকে টিকিট দেয় দল।
বিজেপির ওই আট হেভিওয়েটের মধ্যে রাত পর্যন্ত পাওয়া খবরে ছ’জন এগিয়ে রয়েছেন। হেরে গিয়েছেন ফগন সিংহ কুলস্থ ও সাতনার প্রার্থী তথা সাংসদ গণেশ সিংহ। রাজনীতিকদের মতে, হেভিওয়েট প্রার্থীদের নামানোয় এক দিকে যেমন ওই কেন্দ্রগুলির অধিকাংশে জেতা নিশ্চিত হয়েছে, তেমনই আশেপাশের কেন্দ্রগুলিতেও দলের পক্ষে ভোট টানতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা। অন্য দিকে, বিজেপি একাধিক হেভিওয়েট নামানোয় কার্যত অভিমন্যুর দশা হয়েছে কমলনাথের। সীমিত ক্ষমতা নিয়ে একা হাতে এই হেভিওয়েটদের মোকাবিলা করতে তাঁকে ছুটতে হয়েছে কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রে। ফলে অন্যত্র সে ভাবে মনোযোগ দিতে পারেননি তিনি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের প্রার্থী করায় মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী যে কেউ হতে পারে, সেই বার্তা দিতেও সক্ষম হয় বিজেপি। সেই চালে ব্যক্তি শিবরাজের বিরুদ্ধে মানুষের যে ক্ষোভ ছিল, তা অনেকটাই উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনীতিকেরা।
এ ছাড়া যে বিষয়টি মূলত দু’দলের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে, তা হল সংগঠন। গোড়ায় পরাজয় নিশ্চিত জেনেও সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপায় বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার। ‘লাডলি বহেনা’ যোজনায় মহিলাদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া ও নরেন্দ্র মোদী প্রচারে নামার পর থেকে হাওয়া ঘুরছে বুঝতে পেরে দলীয় কর্মীরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে পথে নামেন। একেবারে ভোটের দিন সমর্থকদের লাইনে দাঁড়ানো নিশ্চিত করে তবেই মাঠ ছেড়েছেন দল অন্তপ্রাণ এই কর্মীরা। অন্য দিকে ফলেই প্রকাশ, গোটা রাজ্যে সংগঠন ভাল করে খাড়া করতেই ব্যর্থ হয়েছেন কমলনাথ। তিনি সংগঠনের চেয়ে নিজের ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মার উপরে বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। ভেবেছিলেন তাঁকে দেখেই ভোট দেবে লোকে। ফলে উপেক্ষিত রয়ে যায় সংগঠন। শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের সাংগঠনিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বাজিমাত করে বিজেপি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy