রবীন মণ্ডল
ওই তীব্র, তীক্ষ্ম, প্রতিবাদী তুলি নব্বইয়ে এসে থেমে গেল হঠাৎ, মঙ্গলবার গভীর রাতে। তাঁর নিশ্চল শরীরের মতো যেন তখন তাঁরই অনন্য সব সৃষ্টির আদিম প্রত্নশিল্পময় রঙিন মুখগুলির আশ্চর্য নীরবতা শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাল। অয়েল, অ্যাক্রিলিকের দুরন্ত অথচ অদ্ভুত শান্ত সব মুখাবয়ব। তাঁর সর্বশেষ রেট্রোস্পেক্টিভ প্রদর্শনীর আগেও বড় মাপের একটি প্রদর্শনীতে শিল্পীকে প্রশ্ন করেছি, ‘‘রবীনদা, অনেক ছবিতেই বড্ড বেশি রুয়োঁর প্রভাব মনে হচ্ছে।’’ চমকে দিয়ে বললেন, ‘‘জর্জ রুয়োঁ যে প্রভাবিত করেননি তা নয়। ওঁর কাজ ভাল লাগে। আসলে কী জানো, বহু শিল্পী আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।’’
১৯২৯-এ হাওড়ায় জন্ম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কমার্সের স্নাতক রবীন মণ্ডল কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে পরবর্তী সময়ে কোর্স সম্পূর্ণ করেন। ছাত্রাবস্থাতেই অসংখ্য পেনসিল, কালিতুলি, পেনইঙ্কের কাজে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষ, অবদলিত, অবনমিতদের নিয়ে বিস্তর ড্রয়িং করেছেন শিল্পী। ১৯৬৪ সালে আট জনের একটি দল নির্মাণ করে তাঁরা নামকরণ করেছিলেন ‘গ্রুপ অব এইট’। পরবর্তী সময়ে ‘ক্যালকাটা পেন্টার্স’ হিসেবে দলের খ্যাতি হয়। রবীন মণ্ডল ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পরে স্ত্রীর মৃত্যু, নিঃসন্তান শিল্পী তখন স্বাভাবিক ভাবেই ভীষণ মূহ্যমান। কিন্তু লড়াকু মানসিকতা বিপুল প্রেরণায় উজ্জীবিত করে ফের দুর্গম আত্মপ্রত্যয়ে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিল ঈজেল ক্যানভাসের বিপরীতে।
কবিতা লিখতেন, তাঁর শিল্পকলা বিষয়ক বিভিন্ন লেখা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। তাঁর শিল্পচর্চা সম্পর্কিত গ্রন্থের সমালোচনা পড়ে আর এক প্রয়াত শিল্পী উচ্ছ্বসিত হয়ে দেশ পত্রিকায় জানিয়েছিলেন, ছবি ভাস্কর্যের সমালোচনা শিল্পীরা যতটা পারেন, অন্যরা নন। রবীন মণ্ডলের নশ্বর শরীর বিলীন আজ। যা রেখে গেলেন, তার ঔজ্জ্বল্যের আড়ালে রয়ে গেল আর্তনাদ ও আকুতি, আলোড়ন ও আনন্দ, আন্দোলন ও আধুনিকতা।
(লেখক চিত্রশিল্পী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy