ছানি কাটার অস্ত্রোপচারের পর যে এমন ভোগান্তি হবে, তা জানা ছিল না মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের। অবশেষে আড়াই মাস পরে সুস্থ হলেন তিনি।
ছানি কাটা এখন আর তেমন কঠিন বা ভয়ের কিছু নয়। সুস্থ হতে সময়ও লাগে কম। চিকিৎসকরা বলেন, আগের মতো আলাদা ঘরে দিনের পর দিন আটকে থাকতেও হয় না রোগীদের। কিন্তু মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের অভিজ্ঞতা তেমন নয়। ছানি কাটাতে গিয়ে খানিক বেশিই ভুগতে হয়েছে তাঁকে। দ্বিতীয় বার অস্ত্রোপচারের পরে এখন তিনি সুস্থ হলেও ভুলতে পারছেন না দীর্ঘ ভোগান্তির কথা। চিকিৎসা বিভ্রাটের জেরে সেই নাজেহাল হওয়ার অভিজ্ঞতা প্রকাশ্যে এনেছেন তিনি।
কী এমন হয়েছিল যে এত সময় লাগল ঠিক হয়ে উঠতে?
সাধারণত ফেকো পদ্ধতিতে চিকিৎসার পরে রোগীদের সপ্তাহখানেক অতিরিক্ত যত্নে থাকতে বলেন চিকিৎসকরা। তেমনই বলা হয়েছিল রত্নাবলীকেও। কিন্তু তিনি সুস্থ হতে পারেননি কয়েক সপ্তাহ পরেও। আনন্দবাজার অনলাইনকে রত্নাবলী বলেন, ‘‘আমার ৪ নভেম্বর প্রথম অস্ত্রোপচার হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা আদৌ হয়নি।’’ নভেম্বর তো গেলই, সঙ্গে গোটা ডিসেম্বরও তাঁর চোখের চিন্তাতেই কেটেছে। অস্ত্রোপচারের পরও দৃষ্টি না ফেরায় পরিজনেরা রত্নাবলীকে দ্বিতীয় কোনও চিকিৎসককে দেখানোর পরামর্শ দেন। সেটাই করেন তিনি। এর পরে আবার অস্ত্রোপচার হয় ২ ডিসেম্বর। সেটা অবশ্য সফল হয়। ধীরে ধীরে দৃষ্টি ফেরে। এমন অভিজ্ঞতার পরে রত্নাবলীর প্রশ্ন, ‘‘আমার এত দিনের এই ট্রমার খেসারত কে দেবেন?’’ যে চিকিৎসকের জন্য এমনটা হয়েছে বলে রত্নাবলীর অভিযোগ, তিনি অবশ্য কোনও কথা বলতেই রাজি নন।
রত্নাবলীর চোখে প্রথম অস্ত্রোপচার করেছিলেন, চিকিৎসক বি কে সরকার। রোগী কষ্টে থাকলেও তিনি গোটা সময়টাই নাকি ভরসা রাখতে বলেন। সেই অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে নেটমাধ্যমে একটি পোস্ট করেছেন রত্নাবলী। তিনি লিখেছেন, ‘‘নভেম্বরে, ছানি অপারেশনের পরে, পরপর প্রয়োজনীয় কাজগুলোতে নিজে যখন যেতে পারছিলাম না, পুরোটাই সহকর্মীদের উপরে নির্ভর করতে হয়েছে, তখন আমার দৃষ্টিতে শুধু একটা গোলাকার বস্তু, তার দুপাশে দু’টি হুক। তার পরে আর কিছু আছে কি না ঠাহর হচ্ছিল না। ও দিকে ‘সুনেত্রা’-য় ডাক্তার বি কে সরকার আমাকে বলে চলেছেন ‘বি পজিটিভ’।’’
এ দিকে, সমস্যা বাড়তে শুরু করেছে। তাই চিন্তাও বেড়েছে। ফলে আবার সেই চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন রত্নাবলী। তাঁর বক্তব্য, ‘‘চিকিৎসকের কথা শিরোধার্য করে আমি যত পজিটিভ থাকার চেষ্টা করছি, চোখ তত তেড়েফুঁড়ে ফুলে উঠছে, লাল হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনের থেকে বেশিই পজিটিভ হয়ে গেলাম কি না, এই ধন্দে যখন ফের ডাক্তারবাবুর দ্বারস্থ হলাম, তিনি এমন ওষুধ দিলেন, রাতে বুক ধড়ফড় করা আর থামে না। রাত যদি না কাটে, তা হলে ঘুমের চেষ্টা অকারণ বিবেচনা করে, পরপর রাতজাগা।’’
এমন পরিস্থিতি চলতে থাকায় দ্বিতীয় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে যান রত্নাবলী। তিনি জানিয়েছেন, চিকিৎসক বিকাশ বসুর পরামর্শ পেয়েছিলেন বলেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পেরেছেন। তবে এক দিনে প্রথম চিকিৎসকের উপর ভরসা ছাড়েননি। দিনের পর দিন অসুবিধা হওয়ায় আত্মীয়-বন্ধুরাই বলেন তাঁকে অন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে। যাঁদের কথায় তিনি নতুন চিকিৎসকের কাছে গেলেন, তাঁদের এক জন অপ্টোমেট্রিস্ট শুভায়ু মজুমদার। আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘রত্নাবলীদির প্রথম অস্ত্রোপচারের পর যা যা উপসর্গ দেখা যাচ্ছিল, তার কোনওটিই স্বাভাবিক নয়। একটা অস্ত্রোপচারের পর সামান্য ব্যথা বা লাল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ফেকোর পর রাতারাতি দৃষ্টি ফেরে। হেমারেজ হয় না। রত্নাবলীদির ক্ষেত্রে সাবকঞ্জাংটাইভাল হেমারেজ ছিল। ছানি কাটার পর যে লেন্সটা লাগানো হয়, সেটা ঠিক জায়গায় বসেনি। ভিট্রিয়াস চেম্বারে ড্রপ করেছিল। বাকি উপসর্গগুলি তা বলে দিচ্ছিল। এর জেরে রেটিনার ক্ষতিও হতে পারত। ফেকো করার সময়ে ভুল যদি হয়ে থাকে, তবে তা সামাল দেওয়ার জন্য ভিট্রেক্টমি করা দরকার। রত্নাবলীদির সেটা দরকার ছিল। এ ক্ষেত্রে ওই চিকিৎসক সেটা করেননি। বরং, উল্টে বার বার বলেছেন ‘বি পজিটিভ’। চিকিৎসায় অনেকটাই গাফিলতি হয়েছে।’’
সমস্যার সমাধানে সেই অস্ত্রোপচারটি করেন চিকিৎসক বিকাশ বসু। রত্নাবলী তাঁর পোস্টে লিখেছেন, ‘‘দ্বিতীয় চিকিৎসকের মতামত নিতে গিয়ে জানলাম, মূল সার্জারিটাই ডিজ্যাস্টার হয়েছে। ছানি পরিষ্কার হয়নি। লেন্সটা ঠিক জায়গায় বসেনি। সেটা ভিট্রিয়াস জেলির মতো চোখের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। হুক ওয়ালা গোলাকার বস্তুটা আসলে লেন্স। আজকের দিনে ফেকো সার্জারির এমন পরিণতি যে হতে পারে, আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।’’
আনন্দবাজার অনলাইকে বিকাশবাবু জানান, ফেকোর পর লেন্স ড্রপ করে যাওয়ার সমস্যা মাঝেমধ্যে ঘটে থাকে। তখন আবার অস্ত্রোপচার করতে হয়। তিনি বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রেও লেন্স ড্রপ করে গিয়েছিল। আসলে সকলের রেটিনা এক রকম নয়। তাই অনেক সময়ে অস্ত্রোপচারের পরও লেন্স সেট করে না। নতুন করে আবার বসাতে হয়। এমন অস্ত্রোপচার জটিল হয়। খুব সাবধানে করতে হয়।’’
দ্বিতীয় বার অস্ত্রোপচারের পর ধীরে ধীরে দৃষ্টি ফেরে রত্নাবলীর। জানুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ হয় চুড়ান্ত চক্ষু পরীক্ষা। তার পর থেকে অনেকটা সমস্যামুক্ত মনে করছেন নিজেকে। গত আড়াই মাসের ভোগান্তির কথাও সকলকে জানিয়েছেন। সেই পোস্টের নীচে মন্তব্যের জায়গায় এসেছে অন্যদের ভোগান্তির কথাও। চিকিৎসায় গাফিলতির কারণে যে এমন সমস্যা হতেই থাকে, তা সব সময়ে হয়তো সকলের নজরে আসে না।
আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল চিকিৎসক বি কে সরকারের সঙ্গেও। তিনি অবশ্য এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। বলেন, ‘‘যাঁর বিষয়ে কথা বলার, তাঁর কোনও প্রশ্ন থাকলে সেই রোগীকেই বলব। এ বিষয়ে অন্য কারও সঙ্গে কথা বলা বেআইনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy