Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
bengali theatre

‘কোনও মেয়েকে ভাল লাগলে কৌশিক আমায় এসে বলে দেয়’

কৌশিক সেনের সঙ্গে ২৫ বছর কাটানোর পরেও বিশ্বাস অটুট রেশমী সেনের।

‘আর পাঁচটা দম্পতির মতো আমাদেরও জীবনে প্রচুর ওঠানামা এসেছে’। ছবি: সংগৃহীত

‘আর পাঁচটা দম্পতির মতো আমাদেরও জীবনে প্রচুর ওঠানামা এসেছে’। ছবি: সংগৃহীত

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৯:৫৯
Share: Save:

মাধ্যমিক শেষ হল এক জনের। আর এক জন উচ্চমাধ্যমিক দেবে।

এর মাঝেই এল চিঠি। প্রথম সম্বোধনেই ‘সুচরিতাসু...’।

হাতের ওপর হাত রাখা। দু’জনের চোখে এক ভাবে দেখা নাটকের মঞ্চ। বিছানা এক। চায়ের কাপে উষ্ণতার চুমুক। এ ভাবেই পঁচিশ বছর পার। বাবান আর বুরু। কৌশিক আর রেশমী সেন। একমাত্র আনন্দবাজার ডিজিটালের কাছে প্রকাশ করলেন পঁচিশ বছরের দাম্পত্যে প্রেম, রাগ আর অভিমানের কথা।

কৌশিক সেনের সঙ্গে পঁচিশ বছর কাটানো যায় তা হলে?

রেশমী: (মিষ্টি হেসে) ভীষণ যায়। আমাদের বিয়ের পঁচিশ বছর হল। কিন্তু সম্পর্কের একত্রিশ। আর সেই মাধ্যমিক থেকে আমি এতটাই ওর প্রেমে ভরে থাকি যে সত্যি কথা বলতে গেলে অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে প্রেমই হল না!

‘বিয়ের পঁচিশ বছর হল, কিন্তু সম্পর্কের একত্রিশ’-ছবি: সংগৃহীত

কৌশিক, চিঠি পাঠিয়ে যে ক্লাসিক্যাল প্রেমের সূচনা সেই প্রেমকে রোজ দেখতে দেখতে, ব্রাশ করা থেকে বাজারের হিসেবে টেনে আনতে কেমন লাগে?

রেশমী: এই প্রশ্নের দু’ভাবে উত্তর দিতে চাই। প্রেম, বিয়ে প্রথম কিছু দিন ফিজিক্যালিটি রইল। তার পর সামাজিক স্বীকৃতির জায়গা এল। কিন্তু তার পর? এই তার পরের জায়গাতেই আমাদের দু’জনের মধ্যে নাটক এসে দাঁড়ায়। আর পাঁচটা দম্পতির মতো আমাদেরও জীবনে প্রচুর ওঠানামা এসেছে। আমার স্বীকার করতে কোনও অসুবিধে নেই যে আমার দায়িত্বহীনতাও বার বার এই সম্পর্কের সামনে বড় হয়েছে। রেশমী অনেক পরে থিয়েটারে এসেছে। আবার থিয়েটার ছিল বলেই ওকে ওর জায়গায় দেখতে পেয়েছি আমি। আমাদের দাম্পত্যের ক্ষতি আর বৃদ্ধি দুটো দিক সামলেছি নাটক আর ঋদ্ধির জন্য।

রেশমী দেরিতে থিয়েটারে এলেন কেন? আপনি তো ‘স্বপ্নসন্ধানী’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য?

রেশমী: আমার শ্বশুরবাড়িতে চাওয়া হয়নি যে আমি কাজ করি। বিয়ের আগে থেকেই আমি প্রচুর টিউশনি করতাম। আমি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে হলেও ভাবতাম, বাবার কাছে হাত পাতবো না। সেই আমি বিয়ের পর এতটাই প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম যে মনে হল, চাকরি করতে গিয়ে যদি ওকে ছাড়তে হয়? থাক। আমরা দু’জনেই ছোট ছিলাম। সেল্ফ আইডেন্টিটি নিয়ে মাথা ঘামাইনি।

‘আমরা দু’জনেই ছোট ছিলাম। সেল্ফ আইডেন্টিটি নিয়ে মাথা ঘামাইনি’-ছবি: সংগৃহীত

কৌশিক: শুধু তাই নয়, ’৯৩-তে আমার বাবা মারা গিয়েছে। যথেষ্ট ক্রাইসিস, তখন ও কাজ করলে ভাল হত আমাদের। সেটা আজ বুঝতে পারি।

রেশমী: সেই ম্যাচিওরিটি থাকলে আমি অনেক আগেই নাটকে আসতে পারতাম। আমায় নাটক করতে না দিতে পেরে বাবানের আক্ষেপ থেকে গিয়েছে। আবার দেরিতে আসার আক্ষেপটাও রয়ে গিয়েছে। যার জন্য এখন আমায় ধারাবাহিক করতে হয়। তবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আমায় ধারাবাহিক দিয়েছে। যদিও এটাও ঠিক, থিয়েটারে এমন সব চরিত্র করেছি যা এক জন অভিনেত্রী সারা জীবনেও করে উঠতে পারে না।

এখনও কি লোকে বলে কৌশিক সেনের বউ?

রেশমী: হ্যাঁ এখনও বলে। একটা সময় মনে হত, কৌশিক সেনের বউ হয়েই থাকব?

কৌশিক: গ্রুপ থিয়েটারের সংগঠনে মধ্যবিত্ত মানসিকতা ঢুকে পড়ে। আর দলে যদি পরিবারের মানুষ থাকে তা হলে তো কথাই নেই। অল্প বয়স থেকে আমি শুনছি, বাবা, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত তো সবেতে!

রেশমী: সবেতে ছড়ি ঘোরায়। আর মজার কথা, এগুলো মেয়েদেরই বলা হয়। মণিপুরের সাবিত্রী হেইজনাম! সাঙ্ঘাতিক!

আরও পড়ুন: সামনে এলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ

কৌশিক: তর্কের খাতিরে যদি ধরি, রুদ্রবাবুই কিছু বলছেন, দায় বর্তাবে স্বাতীদির ওপর। উৎপল দত্ত সারা জীবন আর্ট কালচার করেছেন। শোভা সেন যাবতীয় ভুল কাজ করেছেন। আমি তো জানি, শোভা সেন নাটকের জন্য বাড়ি বিক্রি করেছিলেন। রেশমীও ‘মুখোমুখি বসিবার’-এর সময় হাতের বালা খুলে দিয়েছিল। আমি অনেক পরে জেনেছি। বাংলা থিয়েটারে মেয়েদের বিরাট কনট্রিবিউশন আছে।

আমিও শুনেছি রেশমী রাগী দাম্ভিক!

রেশমী: এখন হয়তো কেউ বলবে না। কিন্তু অলিখিত নিয়ম, দলের সেক্রেটারি হয়েও গলা তুলে কথা বলতে পারব না। আমাদের কোনও ইগো ক্ল্যাশ নেই এ সবে। দু’জনেই দু’জনের সাফল্য চাই।

ঋদ্ধি তো সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছায় মানুষ হয়েছে?

রেশমী: এই বিষয় আমি কারও কথা শুনিনি। ওকে কোনও অস্বস্তিকর পরিবেশে ফেলিনি।

কৌশিক: অ্যামাজনের দ্বিতীয় শুট করে ও এখন পুরুলিয়ায় ‘বিসমিল্লা’ শুট করছে। টানা বাহাত্তর ঘণ্টা কাজ করছে ছেলেটা। কিন্তু ওকে বুস্ট করতে হয়। আর সেটা রেশমীই করে।

ঋদ্ধি আসলে বেশ পারিবারিক...

রেশমী: ওর রিল্যাক্স করা মানে পার্টি করা, রাতে আমার আর বাবানের সঙ্গে বসে চা নিয়ে নানা বিষয়ে আড্ডা। ও আমাদের কোত্থাও ছাড়ে না। এই যে বিয়ের পঁচিশ বছরের কথা ভেবে আমরা দু’জন ঠিক করেছি, ছুটি নিয়ে জাস্ট বেরিয়ে পড়ব। ও তো পারবে না। ওর মুখ ভার হবে। সেটা শুনে সুরঞ্জনা, ওর বান্ধবী বলেছে, দেখবে ও লুকিয়ে গাড়ির ডিকিতে উঠে পড়বে।

‘ঋদ্ধির রিল্যাক্স করা মানে পার্টি করা, রাতে আমার আর বাবানের সঙ্গে বসে চা নিয়ে নানা বিষয়ে আড্ডা’-ছবি: সংগৃহীত

এই আড্ডায় ইন্ডাস্ট্রি আসে?

রেশমী: ইন্ডাস্ট্রির মানুষ নিয়ে গসিপ, চর্চা আমাদের ড্রয়িংরুমের আড্ডায় আসে না।

কৌশিক: সোম-বুধ-শুক্র হল দল। ফিল্মে প্রত্যেকের আলাদা আড্ডা আছে। আমরা পাগলের মতো থিয়েটার করে গিয়েছি। ‘স্বপ্নসন্ধানী’-কে একটা জায়গায় তো নিয়ে গিয়েছি। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা ফেস্টিভ্যালে ন’বার গিয়েছে আমার দল। আমি নিজে পরিচালনাও করেছি। এই ন’বারের মধ্যে চার বার ওর বড় ভূমিকা আছে। লেডি ম্যাকবেথ, মাদার কারেজ, অ্যান্টিগনি চরিত্রে ও ভারতের মাঠে গিয়ে খেলেছে।

কৌশিক সেনের প্রেমে পড়ার খবরও পৌঁছয় না?

রেশমী: কৌশিকের কাউকে ভাল লাগলে ও আমায় এসে বলেই দেয়। কী গল্প হল সেটাও বলে। আজ অবধি মারাত্মক সিরিয়াস প্রেমে কৌশিক পড়েনি। তবে ওর মধ্যে দারুণ একটা প্রেমিক সত্তা আছে। এমনকি, আমার ছেলের মধ্যেও আছে। আমার এ নিয়ে খারাপ লাগা নেই। বাবান খুব সরল সাদাসাপ্টা। ডাল-ভাত খেয়েও খুব খুশি। আর খুব কেয়ারিং।

শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?

রেশমী: সত্যি কথা বলব?

হ্যাঁ।

রেশমী: ভাল নয়।

কৌশিক: আমি বলব, এখন ভাল।

রেশমী: এখন ভাল। মা-র প্রচুর স্ট্রাগল আছে। সেটা শিল্পী হিসেবে করতে করতে মা কড়া হয়ে উঠেছিলেন। সেই কড়া ভাবটা আমার ওপর এসে পড়েছিল। সময় গিয়েছে, এখন মা বোঝে, নাহ্, ও তো এর তুলনায় ভাল।

আরও পড়ুন: ‘ইতিহাস বিকৃত হয়েছে’, মামলার মুখে কাশ্মীরি পন্ডিতদের নিয়ে বিধু বিনোদের ‘শিকারা’

কৌশিকের এই সম্পর্কে অসুবিধে হয়নি?

কৌশিক: অসুবিধে হয়েছে তো। আমি তো খুব পারিবারিক। ’৯৫-এ বিয়ে হয়ে ২০০৮-এ বাড়ি ছেড়েছি। সময়ে বুঝেছি আইডিয়াল ছেলে, আইডিয়াল স্বামী, বাবা হয় না। মা-ও তো এক জন আর্টিস্ট, সে তো টিপিক্যাল শাশুড়ি হবে না। দূর থেকে মায়ের কাজের প্রশংসা শুনি, এটা খুব ভাল লাগে।

রেশমী: মা আর্টিস্ট বলেই আমার অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন বহু বার। বাবানের পরিচালনার খুঁত ধরেছেন কিন্তু আমার প্রশংসা করতে দ্বিধা করেননি। মা-র সঙ্গে সম্পর্ক কড়া হয়তো তখন। তবুও মা বলেছে।

তাঁরা বেরিয়ে পড়লেন অজানায়। কৌশিকের চোখে রেশমীর উপহার দেওয়া বাহারি চশমা। আর রেশমীর আঙুলে কৌশিকের দেওয়া হিরের আংটি।

রেশমী সামনে এলে আজও কৌশিক দেখতে পান বুনো ঝোপ...

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy