Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Soumitra Chatterjee

আমার লাল ডায়েরিতে এখনও ফাঁকা পড়ে আছে ডিসেম্বরের ডেট

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্যুট করা শেষ ছবি 'বেলাশুরু'র অন্যতম পরিচালক লিখলেন তাঁর অভিজ্ঞতা।উনি আমার মায়ের থেকে এক বছরের বড়। কাজেই ওঁর মুড সুইংগুলো বুঝতে আমার অসুবিধা হত না।

উনি আমার মায়ের থেকে এক বছরের বড়। কাজেই ওঁর মুড সুইংগুলো বুঝতে আমার অসুবিধা হত না।

উনি আমার মায়ের থেকে এক বছরের বড়। কাজেই ওঁর মুড সুইংগুলো বুঝতে আমার অসুবিধা হত না।

শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২০ ২০:১৪
Share: Save:

ওঁর কোনও দিনও বেলাশেষ হবে না। ওঁর তো বেলাশুরু হবে! বেলাশুরু... বাঁচা শুরু।

আজ এই মূহূর্ত থেকে উনি আমার মধ্যে, আমাদের মধ্যে আরও বেশি করে বাঁচতে শুরু করবেন। আরও অভাব বোধ তৈরি হতে শুরু করবে।

ওঁর জীবনে সবসময়েই বেলাশুরু।

একটা লাল রঙের সরু ডায়েরি, যার সমস্ত দিক সবসময় ভর্তি থাকত। ২০১২-র ২ নভেম্বর থেকে ওই ডায়েরিতে আমাদের জায়গা হয়। ‘অলীক সুখ’-এর জন্য ফোন করেছিলাম। এক দিন লাগবে একটি দৃশ্যের জন্য। রেগে গিয়েছিলেন। প্রথমে করতে চাননি ছবিটা। তারপরে চিত্রনাট্য শুনে রাজি হন।

১৪ ডিসেম্বর ২০১২, প্রথম শ্যুটিং করেছিলাম ওঁর সঙ্গে। ব্যস, সেই থেকে আমার সব শীতকাল আর ডিসেম্বরের ওপর অধিকার যেন ওঁরই হয়ে গেল। ২০১৪-র ডিসেম্বর ‘বেলাশেষে’। ২০১৫ ‘প্রাক্তন’। ২০১৬ ‘পোস্ত’। ২০১৭ ‘মনোজদের অদ্ভূত বাড়ি’। ২০১৮ ‘বেলাশুরু’।

দুই পরিচালক শিবপ্রসাদ এবং নন্দিতার মাঝে সৌমিত্র।

২০১৯ সালে শ্যুটিং করিনি। ২০২০-র ১৪ ডিসেম্বর থেকে ডেট চেয়েছিলাম দু’মাসের জন্য। বলেছিলেন, ‘‘থিয়েটারের জন্য আলাদা করে ডেটগুলো সরিয়ে রাখতে হবে। বাকিটা অ্যাডজাস্ট করে নেব।’’ কথা ছিল, বড় একটা কাজ শুরু হবে।

এই আট বছরে কী দেখলাম? দেখেছি নিয়মকে। সৌমিত্রবাবুর পুরো জীবনটা তো একটা নিয়ম। কখন ওষুধ খাবেন, কখন উঠবেন, কখন বাড়ি থেকে বেরোবেন, কখন গাড়িতে উঠবেন। কলটাইম ৯টায় মানে উনি পৌনে ৯টায় পৌঁছবেন। স্ক্রিপ্ট মুখস্থ। প্রত্যেকটা শব্দের মানে তৈরি করা আছে নিজের মধ্যে। দেখলাম পেশাদারিত্ব।

‘পোস্ত’র সময় নাতির অ্যাক্সিডেন্টের পরেও সিনেমার প্রমোশনে এসেছিলেন। যেখানে উনি জানতেন সিনেমার বিষয় দাদু এবং নাতি। টাকার জন্য এসেছিলেন? নাহ্! এসেছিলেন পেশাদারিত্বের দায় থেকে। কথা দেওয়া আছে বলে। ডায়েরিতে ডেট লেখা আছে। সবাই বলত, সাড়ে ৪ ঘণ্টার বেশি উনি সময় দেন না। ভুল কথা। ‘বেলাশুরু’-র ক্লাইম্যাক্সে ৯ ঘন্টা শ্যুট করেছেন। কারণ, জানতেন কম্বিনেশন ডেট পাওয়া যাবে না এত জন শিল্পীর। ‘‘কাজ না করলে আমি যে পাগল হয়ে যাব শিবপ্রসাদ,’’— ওঁর সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার সময় এই কথাটা বলেছিলেন আমায়। সত্যিই তাই। ডায়েরির প্রত্যেকটা পাতা যেন ওঁর ভর্তি চাই।

‘বেলাশেষে’ করে উনি তো সব রেকর্ড ভেঙে দিলেন!

নিজের জন্মদিন কাজের মধ্য দিয়ে পালন করতেন। ব্যক্তিগত জীবন আর আবেগ নিজের মধ্যে রাখতে পছন্দ করতেন। ‘পোস্ত’-র শ্যুটিংয়ের সময় ওঁর স্ত্রী দীপাবউদি অসুস্থ হন। হাসপাতালে ছিলেন। সৌমিত্রবাবু একদিনও শ্যুটিং বন্ধ করতে বলেননি।

শান্তিনিকেতনে চলছে শ্যুটিং। আর দীপাবউদি কলকাতার হাসপাতালে। কিন্তু কাজ বন্ধ থাকেনি। শ্যুটিং চলাকালীন ব্যক্তিগত জীবনের বিপর্যয়ের কথা কেউ জানতে পারেনি। শুধু একদিন স্যুট পরে ডাবিংয়ে এসেছিলেন। বললাম, ‘‘কী ব্যাপার, হঠাৎ?’’ বললেন, ‘‘দীপাকে নিয়ে টলি ক্লাবে লাঞ্চে যাব।’’

ব্যস, ওইটুকুই।

উনি আমার মায়ের থেকে এক বছরের বড়। কাজেই ওঁর মুড সুইংগুলো বুঝতে আমার অসুবিধা হত না। উনি প্রতিযোগিতা ভালবাসতেন। এটা কেউ জানে না। এখানেই উনি ‘লেজেন্ড’ এবং মানুষ।

‘বেলাশেষে’ দুই বয়স্ক মানুষের প্রেমের গল্প। সৌমিত্রবাবু অনেক দিন পর পোস্টার হিরো। ১ মে ছবি রিলিজ করেছিল। ৩ মে সকালবেলা উনি ফোন করলেন, ‘‘যা শুনছি তা কি সত্যি? আমরা কি পেরেছি ওদের কে হারাতে?’’

ওদেরটা কারা স্যর? মনে প্রশ্ন এলেও জানতে চাইনি। কাদের হারাতে চেয়েছিলেন উনি? কাদের জবাব দিতে চেয়েছিলেন উনআশির সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়? কাদের বলতে চেয়েছিলেন লেজেন্ডরা কোনওদিন মরে না? ‘বেলাশেষে’ করে উনি তো সব রেকর্ড ভেঙে দিলেন!

টিম ‘বেলাশেষে’।

পরের বছর ‘প্রাক্তন’ করলেন। একসঙ্গে। তারপর আবার ‘পোস্ত’র জন্য ডেট নিতে গেলাম। আবার সেই লাল ডায়েরি। জানতে চাইলেন, ‘প্রাক্তন’ কেমন চলেছে? ‘বেলাশেষে’-এর চেয়ে বেশি? আমি বললাম, ‘‘ওই আর কি!’’ উনি বললেন, ‘‘বেলাশেষের ক্রেজটা কাজ করেছে তাহলে।’’ ব্যস, ওই একটা কথায় স্তব্ধ করে দিলেন আমায়।

ওঁকে বলেছিলাম, ‘‘আপনিই শেষ। আপনার পর আর কোনও বাঙালি নায়ক এক্ষণ সম্পাদনা আর সিনেমার নায়ক একসঙ্গে হতে পারবেন না।’’

করোনা-পরবর্তী বাংলা ছবির ক্যানভাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা এই মূহূর্তে ‘বেলাশুরু’। যার দিকে সব সিনেমাহলের মালিক তাকিয়ে আছেন। হয়তো এই সিনেমাই হল-এ আবার লোক আনবে। এই সিনেমা দিয়েই হয়তো মোড় ঘুরবে। কাকে দেখতে আসবে তারা? এটাই সৌমিত্রবাবুর ক্যারিশমা।

আমি এবং নন্দিতা রায় একসঙ্গে সিনেমা করি। যৌথ ভাবে কাজ করি। কিন্তু এই ইন্ডাস্ট্রিতে উনিই বোধহয় প্রথম, যিনি আলাদা করে বলতেন, ‘‘নন্দিতা শট ওকে বললে তবেই শট ওকে।’’ সাক্ষাৎকারে বলতেন, ‘‘নন্দিতা একটা আলাদা এক্স ফ্যাক্টর।’’

উনি যে দিন হাসপাতালে গেলেন, আমি নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু মাঝে মাঝে বন্ধু ডাক্তার অরিন্দমকে (অরিন্দম কর) ফোন করেছি। মেসেজ করেছি। ও ওর সময় মতো উত্তর দিয়েছে। অরিন্দম বলেছিল, ‘‘খালি জ্ঞানটা ফেরাতে পারছি না। ব্রেনটা কাজ করছে না। বাকি সব প্যারামিটার কিন্তু স্বাভাবিক।’’

কিন্তু সৌমিত্রবাবু, আপনার তো ওটাই সব। আপনার আঁকা ছবি, আপনার লেখা কবিতা, আপনার নাটক, আপনার সিনেমা, আপনার স্মৃতি।

একদিন অরিন্দম বলল, ‘‘ওঁর পছন্দের কিছু গান পাঠাতে পারবেন? মিউজিক থেরাপি করব। ওঁর ভাল লাগবে।’’

বুঝতে পারছিলাম না, কোন গান আগে দেব। কোনটা পরে! সবচেয়ে আগে রাখলাম কনক বিশ্বাসের ‘আসা যাওয়ার পথের ধারে’। তার পর ভাবলাম, আপনি একবার জর্জ’দার প্রথমদিকের গানের কথা বলেছিলেন। তাই রাখলাম দেবব্রত বিশ্বাসের ‘এ শুধু অলস মায়া’। প্রথম দিকের গাওয়া ‘ওই আসনতলে’। নিজের মতো করে গান সাজিয়ে পেনড্রাইভ পাঠিয়েছিলাম অরিন্দমের কাছে।

জানি না স্যর, ঠিকমতো সাজাতে পেরেছিলাম কি না। ভয় লাগছিল। হয়তো বকবেন পরে। আপনার মনে পড়ছে স্যর, আপনাকে বলতাম, ‘‘একজনকে আপনি ১৪টা ছবির সময় দিয়েছেন। আমাদের অন্তত ১০টা দেবেন।’’ আপনি বলেছিলেন, ‘‘পারব নাকি! আরও ৫ বছর মানে ৯০। অসম্ভব! তখন হয়তো স্মৃতিই কাজ করবে না।’’ কিন্তু এ-ও বলেছিলেন, ‘‘প্রম্পট করে দিলে সংলাপ কোনওদিন ভুলব না। ওটা শিশিরবাবুর থেকে পাওয়া।’’

৫টা ছবির ডেট বাকি আছে স্যর। আপনার দেখাদেখি আমিও লাল ডায়েরি রাখি এখন। কিন্তু আমার ডায়েরিতে ডিসেম্বরের ডেট এ বার ফাঁকা। কবে থেকে রাখব ডেট স্যর? থিয়েটারের ডেটগুলো আলাদা করে রাখব। কথা দিচ্ছি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy