সত্যজিৎ রায় ‘অপুর সংসার’-এর অপর্ণাকে দেখতে পৌঁছে যান শর্মিলা ঠাকুরের বাড়ি।
পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যায়। ‘পথের পাঁচালি’-র পরিচালক ‘জলসাঘর’-এর পর আবার ‘অপু’-র কাছে ফিরছেন।
‘অপু’ এ বার ঘর বাঁধবে। তেইশের সৌমিত্রর জন্য তখন এক বছর তেরোর অপর্ণার সন্ধান করে যাচ্ছেন সত্যজিৎ। কিন্তু কিছুতেই মনের মতো কেউ আসছে না। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে। কিছুই হয়নি। হঠাৎই একজনের দিকে নজর পড়ল তাঁর।
মেয়েটি সেন্ট জন’স ডায়াসেশনে পড়ে। স্মার্ট, ঝকঝকে চেহারা। সেই সঙ্গে আছে আভিজাত্য। ঠাকুর পরিবারের সন্তান। বাবা গীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন স্বয়ং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি। মেয়ের নাম শর্মিলা।
আমার বাবা সত্যজিৎ রায় ‘অপুর সংসার’-এর অপর্ণাকে দেখতে পৌঁছে যান শর্মিলা ঠাকুরের বাড়ি। ওঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য। হলুদ রঙের ফ্রক পরা, বব ছাঁট চুলের সেই মেয়েকেই আমার মা একটি শাড়ি পরিয়ে, চুলে খোঁপা বেঁধে, কপালে টিপ পরিয়ে দিয়েছিল। তৈরি হল অপর্ণা। তেরো বছরের মেয়ে অনায়াসে ক্যামেরার মুখোমুখি। পাশে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
একের পর এক দৃশ্য সামনে ভেসে ওঠে।
যেমন বিয়ের পর ফুলশয্যার রাতে অপু আর অপর্ণা। ব্যাকগ্রাউণ্ডে মাঝির ভাটিয়ালি গানের সুর। দূরে অপর্ণা উনুন ধরাচ্ছে। অপু দেখছে। অপর্ণার আঁচল আটকা পড়েছে অপুর কাছে। অপু বাঁশি বাজাচ্ছে…। এমন আরও অনেক।
এ সব দৃশ্য আমার দেখা। কিন্তু এই ছবি তৈরির সময় আমি ছিলাম না। তাই সরাসরি বাবা ওঁকে শ্যুট করছেন এমন দেখিনি। তবে রিঙ্কুদিকে বলতে শুনেছি, “সৌমিত্রর সঙ্গে আমার প্রথম ছবির (আমার জীবনেরও প্রথম ছবি) প্রথম শটের মুহূর্তটাই কেমন যেন প্রতীকী বলে মনে হয়। একটা দরজা খুলে আমাকে নায়ক বলছেন, ‘এসো’। শুরু হচ্ছে আমার স্ক্রিন কেরিয়ার।’’
রিঙ্কুদির কাছেই শোনা, বাবা নাকি অভিনয়ের সময় প্রতি বিষয়ে খুঁটিনাটি সব বলে দিতেন। রিঙ্কুদি কতটা ডান দিকে তাকাবে? কতটা চোখ তুলবে? কোন দিকে তাকিয়ে হাঁটবে? সব। কিন্তু আমি ভেবে আশ্চর্য হই যখন 'অপুর সংসার'-এ আমরা অপর্ণার অভিনয় দেখি তখন কি মনে হয় ক্যামেরার পিছনে অনবরত কেউ ওঁকে এমন নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন? একেবারেই মনে হয় না। এটাই অবাক করা বিষয়। বাবা বলতেন রিঙ্কুদি বাবার সব নির্দেশ হুবহু গ্রহণ করত। এই যে পরিচালক অভিনেতার পারস্পরিক বোঝাপড়া, এটাই রিঙ্কুদিকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করেছিল বলে আমার মনে হয়।
অপু-অপর্ণার সম্পর্ক এক ধরনের সরল দাম্পত্যের ‘আইকন’ হয়ে উঠেছিল বাঙালি মনে। মনে আছে সেই প্রসঙ্গে রিঙ্কুদি বলত, ‘‘রোমিয়ো-জুলিয়েটের পরে কয়েক দশক ধরে অপু-অপর্ণা ছিল সবচেয়ে রোম্যান্টিক জুটি। ছবিটায় অদ্ভুত এক সারল্য ছিল। ওই সময়ে আমাদের জীবনেও যে সারল্য আর আশা ছিল, তা-ই প্রতিভাত হয়েছিল পর্দায়।’’
বাবার পরিচালনায় নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন সেই তেরো বছরের তরুণী। বাবার ছবিতে কাজের নিরিখে ওঁর অভিনয় জীবনকে দু’ভাগে দেখা যেতে পারে বলে আমার মনে হয়। ‘অপুর সংসার’ থেকে ‘দেবী’। এর পরে মুম্বই যাত্রা। পরের পর্যায় ‘নায়ক’ থেকে ‘সীমাবদ্ধ’। পরিণত শর্মিলার আত্মপ্রকাশ।
‘অপুর সংসার’-এর পরের বছরই হল ‘দেবী’। আমার তো মনে হয় আরও শক্ত কাজ। রিঙ্কুদি কী চমৎকার অভিনয় করল।
মানবী আর দেবীর দোলাচলে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পেরেছিল কত কম বয়সে! ছবিতে এক জায়গায় স্বামী উমাপ্রসাদ স্ত্রী দয়াময়ীকে বলছে তার সঙ্গে পালিয়ে যেতে। দয়াময়ী রাজি হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে, সে যদি সত্যিই দেবী হয়, তবে পালিয়ে গেলে তো স্বামীর অকল্যাণ হবে! মানবী থেকে দেবীর এই রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর।
সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে প্রিয় ছবি বললে ওকে ‘দেবী’-র কথাই বলতে শুনেছি। ‘দেবী’ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে রিঙ্কুদি বলেছিল, “সিনেমা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও মেয়েটির মুখ তোমায় তাড়া করে বেড়াবে। যদিও সে সময় আমার বয়স ছোট ছিল। কিন্তু বাংলায় বললে বেশ ‘পাকা’ ছিলাম। আমার মনে আছে ‘দেবী’র সেটে মানিকদা কাউকে অনুমতি দিতেন না আমার সঙ্গে কথা বলতে। ও রকম ভারি মালা পরে ধূপের সামনে দীর্ঘক্ষণ এক ভাবে বসে থাকতে হত সুব্রত’দার সামনে, যা গোটা জিনিসটাকে অপার্থিব করে তুলেছিল। মনে আছে, সেটে এক বার এক বয়স্ক ভদ্রলোক, মনে হয় কোনও জুনিয়র আর্টিস্ট, আমার সামনে শুয়ে পড়ে আমায় প্রণাম করতে শুরু করেন। যেন আমি সত্যিকারের দেবী!”
‘দেবী’ ছবিতে জমিদার কালীকিঙ্কর রায় স্বপ্নে তাঁর ছোট বউমা দয়াময়ীর মধ্যে দেবীর দর্শন লাভ করলেন। পরের দিন সকালে কালীভক্ত শ্বশুর প্রণাম করতে যখন তার সামনে ঝুঁকে পড়লেন, দয়াময়ী মুখে কোনও শব্দই করল না। শর্মিলার সংলাপহীন অভিনয় তার ক্ষোভ আর হতাশার কথা জানিয়ে দিয়ে গেল। শুধু শ্বশুরের সামনে তার পায়ের আঙুলগুলো কুঁকড়ে এল। সে দেওয়ালের দিকে ঘুরে গিয়ে নখ দিয়ে দেওয়ালে আঁচড় কেটে নিজের মধ্যে ভাঙনের সঙ্কেত দিল।
বাবা ওকে বার বার ডেকে পাঠিয়েছে। 'নায়ক'-এর সময় উত্তমকুমারের বিপরীতে রিঙ্কুদি ছাড়া বাবা আর কাউকৈ ভাবতে পারেনি, এমনই ছিল রিঙ্কুদির অভিনয়ের জোর।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র শ্যুট হয়েছিল গরমকালে। পালামৌয়ের যে অরণ্যে শ্যুটিং হয়েছিল, সেই সিপাডহর নামের জায়গাটায় এক মাস পুরো ইউনিটকে থাকতে হয়েছিল। গরমে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! শর্মিলা ঠাকুর তখন বড় তারকা। ওই গরমের মধ্যেও কী অনায়াসে তিনি শ্যুট করতেন। কোনও অভিযোগ নেই। বরং পুরো দলের সঙ্গে শ্যুটিং বাদ দিয়ে বাকি সময় দেদার আড্ডা দিতেন। প্রবল গরমে ওঁরা নিজেদের নাম বদলে ফেলেছিলেন। ‘রবি-পোড়া’ (রবি ঘোষ), ‘শমিত-ভাপা’ (শমিত ভঞ্জ) এমন সব নামে পরিচয় দিতেন।
বাবা চলে যাওয়ার পরেও আমাদের যোগাযোগ থেকে গিয়েছে। একবার তো হঠাৎ কলকাতায় এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আমাদের বাড়ি চলে এসেছিল রিঙ্কুদি। সে দিন কত পুরনো কথা চলে এল। মা বলেছিল কলকাতায় তো ওকে পাওয়াই যায় না!খুব কম সময়ে থাকে। কিন্তু সে দিন আমাদের সকলের ভীষণ ভাল লেগেছিল। এখনও ফোনে কথা, যোগাযোগ থেকে গিয়েছে।
তবে সেলুলয়েডেই নিজেকে আটকে রাখেনি রিঙ্কুদি। ‘ইউনিসেফ’-এর গুডউইল অ্যাম্বাসাডর, সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশনের প্রধান পদের কাজও দিব্যি সামলেছে। এখনও পতৌদিতে গিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটান। হয়তো গোলাপ বাগান করছেন, বিভিন্ন পকেটে স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র গড়ার কাজ করছেন। অন্য দিকে আবার কবিতা পড়ার কোনও অনুষ্ঠানে গিয়ে কবিতাও পড়ছে। বয়স হলেও যে এমন গতিময় থাকা যায়। এত সুন্দর থাকা যায়, তা ওকে দেখেই বোঝা যায়। নানা কাজে নিজেকে প্রকাশ করে চলেছে।
অভিনয়, সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি— যাত্রাপথের বিভিন্ন স্তরে সাফল্যকে ছুঁয়ে দেখেছে। আজও ঘরে এলে ঘরটা আলো হয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy