এইটিথ্রি
পরিচালক: কবীর খান
অভিনয়: রণবীর, দীপিকা,
তাহির, পঙ্কজ
৭.৫/১০
সেটা নব্বই দশকের গোড়ার কথা। কপিলদেব নিখাঞ্জ এসেছেন সেন্ট জেভিয়ার্সে। অরুণদার বিখ্যাত ক্যান্টিনের বড় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে স্কুলের ছেলেদের ভিড়। কলেজের যুবকরা একটু পিছনে। সবাই কপিলকে অনেক কিছু বলছে। কিন্তু কপিল কিছু শুনছেন না। শুধু দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে মাঝে মাঝে মুঠোটা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলছেন।
কী বলছিলেন? রহস্য ভাঙল অনুষ্ঠানের মঞ্চে। কপিল জানালেন, জীবনে এই প্রথম কলেজে পা দিলেন তিনি। তা-ও এত নামী প্রতিষ্ঠানে। তাই নার্ভাস, ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাহস জোগাচ্ছিলেন।
কাট টু ইংল্যান্ড
ঠিক একই কপিলকে দেখা গিয়েছিল ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপের সময়ে। দেখা গেল কবীর খানের ‘এইটিথ্রি’-এর পর্দাতেও। যিনি ইংরেজিতে একেবারেই স্বচ্ছন্দ নন। টিম মিটিংয়ে সতীর্থরা যাঁর ভুল কথার ক্যাচ ধরেন। তা-ও যিনি বিলেতের রানি থেকে সাংবাদিক, কারও মুখোমুখি হতেই ভয় পান না। যেমন তিনি ভয় পান না ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারি থেকে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের। যে যা-ই বলুক, জবাব দেওয়ার একটাই জায়গা তাঁর। মাঠ এবং বাইশ গজ।
এই নিয়েই ‘এইটিথ্রি’র গল্প। একেবারে আন্ডারডগ হিসেবে বিশ্বজয়ের এমন নজির, তা-ও ফাইনালে তখনকার ক্রিকেট বিশ্বের এভারেস্ট ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে হারিয়ে, বাস্তবিকই বিরল। এই কাহিনি সেলুলয়েডে আনতে গেলে আলাদা করে গল্প জোড়ার দরকার পড়ে না। কারণ, বলিউডি রূপকথা হওয়ার মতো সব মশলা আছে বাস্তবেই। এর আগে ‘চক দে ইন্ডিয়া’য় এমন গল্প বলা হয়েছিল। কিন্তু মহিলাদের হকি বিশ্বকাপ জয়ের সেই গল্পের সবটাই কল্পনা। ‘এইটিথ্রি’র সবটাই বাস্তব।
সেই রাত
এই গল্পের শেষ সকলেরই জানা। তা হলে কেন দর্শক বসে থাকবেন আড়াই ঘণ্টারও বেশি সময়? থাকবেন, কারণ জয়টা সত্যিই নাটকীয়। শুধু ফাইনাল নয়। গোটা টুর্নামেন্ট।
প্রথম খেলাই ধরা যাক। তার আগে প্র্যাকটিস ম্যাচগুলোয় মাথা মুড়িয়ে হেরে যাওয়া ভারতীয় দল প্রথমেই পড়ল বাঘাটে ক্যারিবিয়ানদের সামনে। এবং তাদের দুরমুশ করে জিতেও গেল।
তখনও পর্যন্ত দেশে কেউ আলাদা করে খবর রাখছিল না দলটার। ঠিক যেমন পরপর দুটো জয়ের রেশ কাটতে না কাটতে পরপর দুটো হার। বেঙ্গসরকারের মতো নির্ভরযোগ্য ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যানের থুতনিতে আঘাত পেয়ে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাওয়া। এবং মরণবাঁচন ম্যাচে জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে একসময়ে ১৭ রানে ৫ উইকেট।
তার পর?
তার পরের কথা তো জানে দেশের পাঁচ জনে। বরং ২৫ জুনের সেই রাতটাকে একটু ঘেঁটে দেখা যাক।
লর্ডসে সে দিন জয়ের পরে সারারাত পার্টি হয়েছিল ভারতীয় দলের। সিনেমার শেষে পর্দায় এসে কপিল বললেন, ‘‘শ্যাম্পেনের পরে শ্যাম্পেন খোলা হয়েছে। আমি ভয় পাচ্ছিলাম, এত টাকা কে দেবে? কারণ, টুরের শেষ দিনে তখন সকলের পকেট ফাঁকা। ভোর চারটে অবধি পার্টি হয়েছিল। সারা রাত উদ্দাম নাচগানের পরে দেখলাম, খাওয়ার জায়গা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। খালি পেটে শুতে হয়েছিল আমাদের। কিন্তু পেট খালি হলে কী হবে, হৃদয় উপচে পড়েছিল।’’
এ দিকে, জেফ দুজো আউট হওয়ার পর থেকেই জয়ের গন্ধে আনচান করে ওঠে কলকাতা। শেষটায় মাইকেল হোল্ডিং আর জোয়েল গার্নার কিছুটা যেন দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন আগের ম্যাচের মতো। বাড়ি বাড়ি টিভি হয়নি তখন। পাড়ার টিভি-বাড়িতে ভিড়ের মধ্যে কোনও রকমে মাথা গলিয়ে কোনও কোনও তেরো-চোদ্দো বছরের কিশোরকে শুনতে হয়েছিল, ‘‘আবার এসেছিস! আগের বার তো তোর জন্যই ম্যাচটা বেরিয়ে গিয়েছিল।’’
চায়ের দোকানের হলুদ আলোয়, খোলা বারান্দার আধো আঁধারে, রিকশায় বসে, রকে গোল হয়ে তখন শুধুই রেডিয়ো। যেখানে প্রতিটি বলের, প্রতিটি মিনিটের বিবরণী দিচ্ছিলেন ধারাভাষ্যকারেরা। চার দশক পরে এখন দাঁড়িয়ে তা কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু শেষ বলটা সবাই দেখতে চায়। তাই টিভি-বাড়ির ভিড় ঠেলে একটু স্ক্রিন দেখার চেষ্টা।
গোটা দেশ তখন দমবন্ধ করে দেখছে বা শুনছে মহিন্দর অমরনাথের বল। ছবিতে সেই চরিত্রে সাকিব সালিম। সেই বল এসে লাগল হোল্ডিংয়ের প্যাডে। মাঠে জোরদার অ্যাপিল কপিলদের। সেই অ্যাপিল ছড়িয়ে পড়ল ঘর, পথ, দেশে। তার পরে আঙুল তুললেন আম্পায়ার।
সিনেমা
না, কবীরকে কিছু করতে হয়নি। তিরাশি সালের সেই জয়ের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল আস্ত স্ক্রিপ্টটা।
এবং কবীরকে করতে হয়েছে। খুঁজে বার করতে হয়েছে জয়ের নেপথ্যে ছোট ছোট ঘটনাকে। প্রতিটি খেলোয়াড়ের সঙ্গে মিলিয়ে লোক বাছতে হয়েছে। বোলিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিং অ্যাকশনও রাখতে হয়েছে হুবহু এক। সেটা শুধু ভারতীয়দের ক্ষেত্রে নয়। রিচার্ডসের চুইংগাম চিবোনো অবজ্ঞা থেকে ক্লাইভের পাথরের মতো মুখ যখন পেশিতে টান ধরে ভেঙে যাচ্ছে, মার্শাল-হোল্ডিং-গার্নারদের বোলিং অ্যাকশন...
তখন মাঠে এক দিকে ক্যামেরা বসানো থাকত। কখনও ব্যাটসম্যান থাকতেন ক্যামেরার দিকে মুখ করে, কখনও বোলার। কবীর সেটা রেখেছেন। যে ফন্ট, যে স্টাইলে টিভি স্ক্রিনে স্কোর আসত, রেখেছেন সেটাও। খুব ছোট ছোট শটে রয়েছে ফাইনালে শ্রীকান্তের স্কোয়ার কাট বা গাওস্করের ক্যাচ ধরে বল পকেটে পুরে ফেলা। সেমিফাইনালে শেষ দু’টি বলের নাটক বা ফাইনালে হোল্ডিংকে আউট করে মহিন্দরের ছুট— এই ডিটেলিংগুলো সিনেমাকে বাস্তবের কাছে নিয়ে এসেছে।
এই বিশ্বজয়ে দেশপ্রেম আলাদা করে ঢোকাতে হয় না। পরিচালক এই সূত্রে জুড়ে দিয়েছেন ছোট ছোট জীবন-যুদ্ধ, জুড়েছেন সীমান্তের শত্রু ও বন্ধুতা, ক্রিকেটকে সামনে রেখে ইন্দিরা গাঁধীর দাঙ্গা সামলানোর কৌশল, দেশপ্রেমী সংখ্যালঘু, বিলেতের মাটিতে আম-ভারতীয়দের লড়াই... সব সময়ে যে দেশপ্রেম মাপ মতো ছিল, তা নয়। তবে এই ছবিতে একটু পেয়ালা উপচানো ভালবাসায় শেষ পর্যন্ত মূল কাহিনির তাল কাটেনি। বরং পরিচালক বুদ্ধি করে খেলার সত্যিকারের স্টিল ছবিকে মুভিতে জুড়েছেন, পরক্ষণে সেই দৃশ্যেই ফিরে গিয়েছেন রিল-এ।
ছবিতে চমক হিসেবে রয়েছেন কপিলদেব, মহিন্দর অমরনাথ। এবং সচিন তেন্ডুলকরও!
এবং রণবীর
যাঁর কথা না বললে কথা ফুরোয় না, তিনি রণবীর সিংহ। ’৮৩-এর বিশ্বকাপ কপিলদেবের। তাঁর অপরাজিত ১৭৫, তাঁর ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং, সর্বোপরি অধিনায়কত্ব ছড়িয়ে গোটা টুর্নামেন্টে। ছবিতেও তিনি মধ্যমণি। এখানে তাঁর ভূমিকায় কাজটা মসৃণ ভাবে করেছেন রণবীর। এক কথায় অনবদ্য। বাকিরা মাপমতো ঠিক। যেমন রোমি দেবের ভূমিকায় দীপিকা পাড়ুকোন, ম্যানেজার মান সিংহের চরিত্রে পঙ্কজ ত্রিপাঠী। তবে গাওস্কর (তাহির রাজ ভাসিন) কিছুটা চুপচাপ। ঠিক যেমন তাঁর ও কপিলের মধ্যে চলা ঠান্ডা লড়াইও প্রায় অদৃশ্য।
তবু এই রূপকথা, হ্যাঁ, কপিলদেবের ‘প্যান ইন্ডিয়ান টিম’-এর জয় তো রূপকথাই বটে, তাকে এর চেয়ে ভালভাবে কাহিনিচিত্রে ধরা যেত কি না সন্দেহ। এই ‘রূপকথা’ মিস করা উচিত নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy