অঙ্কুশ হাজরা। ছবি: সংগৃহীত।
কলকাতা শহরে গ্যাংস্টার আছে? সিরিয়াল কিলিং হয়? দাউদ টাইপের আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন আছে কি এ মায়ার শহরে? খবরের কাগজ ঘাঁটলে তার বিশেষ প্রমাণ মেলে না। অপরাধ এ শহরে অবশ্যই আছে, কিন্তু তার চেহারা আলাদা। সেখানে দুর্নীতি আছে, সিন্ডিকেট আছে, খাটের তলায় নোট লুকিয়ে রাখার বোকামি আছে। আছে মধ্যবিত্তের ‘লুম্পেন’ সুলভ অজস্র চোরাগোপ্তা মিথ্যে কথা। অথচ মূলধারার সাম্প্রতিক বাংলা ছবিতে বারেবারে দেখি মুম্বইমার্কা আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন বসে আছে খিদিরপুর বা পার্ক সার্কাসের গলিতে। কেবল বিশেষ এক সম্প্রদায়ের মানুষই যেন এ শহরে অপরাধ করে...তাই সব চরিত্রের নামই সুলতান, মির্জ়া, মুসকান। তাদের খুনোখুনি আর মারপিটের বহর দেখে বিস্মিত হতে হয়, মনে পড়ে সত্যজিৎ রায় ‘জন অরণ্য’ বা ‘সীমাবদ্ধ’র মত ছবিতে বাঙালির ধান্দাবাজি দেখাতে স্রেফ বড়বাজার বা রেসের মাঠই বেছে নিয়েছিলেন! হায়।
এত কথা মনে হল সম্প্রতি ইদে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘মির্জ়া’ দেখতে গিয়ে। একটি বাংলা ছবির নাম-‘মির্জ়া’! যেন শাহরুখের ‘জওয়ান’ বা ‘পাঠান’-এর বৈমাত্রেয় ভাই! গরিবের শাহরুখ কি তবে এ ছবির প্রযোজক তথা নায়ক অঙ্কুশ হাজরা! এমত ভেবে হাসি চাপতে হয়… অবশ্যই এ ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় আছেন। আছেন ঐন্দ্রিলা সেন, ঋষি কৌশিক, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়ের মত অভিনেতারা। কাজেই ফ্রেম-টু-ফ্রেম বলিউডি ‘কপি’ বলা যাবে না। তবে অনুপ্রাণিত তো বটেই।
গল্পটা ক্লিশে। সুলতানের ড্রাগ পাচার চক্রের লোকেরা বাচ্চাদের ব্যবহার করে ড্রাগ পাচার করে। নায়ক মির্জ়ার স্নেহের শিশুকে মেরে ফেললে, মির্জ়া নানা তরিকায় সুলতানের দলে ঢুকে, কেরামতি দেখিয়ে তার ছেলের বন্ধু সেজে তিলে তিলে সেই চক্রকে বিনাশ করে। এ দিকে পুলিশরা বোঝে না সে অপরাধী না ভাল লোক। এ সবের মধ্যে আবার মাছওয়ালির ছদ্মবেশে মুসকানের সঙ্গে মির্জ়ার প্রেম হয়। পরে জানা যায়, সে প্রেমও ছিল চক্রান্ত।
এমন ছকে অজস্র ছবি এযাবৎকাল হয়েছে, সন্দেহ নেই। ড্রাগ পেডলারদের নিয়ে সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে এমন কিছু সিরিজ় হয়েছে যে, তার পর এ হেন অতিনাটকীয় বলিউডি ছক খুব একঘেয়ে লাগে। সমাজে অপরাধের মাত্রা বদলেছে। এখনও পেল্লায় বাংলোয় সুবিশাল জোব্বা পরা দানবীয় সুলতান কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখে তাই হাসিই পায়। ও ভাবে কেউ এখন বিরিয়ানি খেতে খেতে বয়স্ক মাকে পাশে নিয়ে বসে শত্রুদের গলা কাটা দেখে নাকি? এ কি মোগাম্বো! তা ছাড়া যা গরম পড়েছে তাতে ও ভাবে কৌশিকবাবুকে ওই পোশাকে দেখতে ভীষণ অস্বস্তিবোধ হয়!
এ ছবির প্রত্যেক শটেই কোনও না কোনও খুন আছে। আর তা থেকেই ছিটকে ফিনকি দিয়ে রক্ত প্রায় সবারই মুখে এসে লাগছে। শান্তিলালবাবু আর শঙ্কর দেবনাথের চরিত্রটা তা-ও কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য লাগে। কারণ বাঙালি পুলিশেরা এখনও অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়ায়, তাদের চোখও ছলছল করে। বা, শঙ্কর দেবনাথের চরিত্রটির মতো বিশ্বাসঘাতক, যারা পুলিশ ও অপরাধীদের মাঝের সেতু, তারাও এ সমাজে কম নেই। কিন্তু এ সব বিশ্বাস ভেঙে যায় ছবির শেষে মুসকানের (ঐন্দ্রিলার) ওই মারাত্মক লাথি-ঘুষি দেখে। উরিব্বাপ! সারা ছবিতে যে লজ্জাবতী লতা, ছবির শেষে সে-ই যেন মহিলা ব্রুসলি!
ইদের বাজারে গরিবের ‘পাঠান’ বা ‘জওয়ান’ এ ছবি, সন্দেহ নেই। সস্তায় বাজার গরম। খিচুড়ি। ছবির শেষে আবার আগামী ছবির ঘোষণাও গুঁজে দেওয়া, তাতে যিশু সেনগুপ্ত অপেরা গাইতে-গাইতে কাকে খুন করে দিলেন দুম করে! সিনেপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে ব্যপারটা বুঝলাম অনেক দেরিতে। পাশের দুই দর্শক যখন বললেন, ‘‘আরে বলিউড ছবিতে এ রকম হয় না! ছবির শেষে আগামী ছবির ঘোষণা...’’ শুনে মাথা হেঁট হয়ে গেল। ছবি-টবি তো অনেক পরের কথা, আগামী ছবি ঘোষণা করার নিজস্ব ভঙ্গিমাটুকুও কি আমাদের নিজের ধরনে আমরা করতে ভুলে গেলাম! নতুন বছর এসে গেল। হায় বাঙালি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy