‘স্পটলাইট’-এর দৃশ্য।
‘থিয়েটার’ শব্দটা শুনলেই আমাদের মাথায় কী আসে? নাটক? মঞ্চ? লাইট? নাকি আরও অনেক কিছু?
থিয়েটার কোনও অহেতুক সময় কাটানোর জায়গা নয়। থিয়েটার কোনও এলোমেলো সান্ধ্যকালীন বৈঠকখানার আড্ডাসুলভ শখের মজলিশও নয়। থিয়েটার একটা সাধনা, একটা জীবনধারা। প্রাচীন, নবীন, বৃক্ষের মতো কখনও সাক্ষী, কখনও আশ্রয়, কখনও নন্দন। সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের তথ্যচিত্র ‘স্পটলাইট’ দেখার পরে, এই কথাটিই বার বার মাথায় আসতে বাধ্য।
সৈকত মজুমদারের ‘দ্য ফায়ারবার্ড’ উপন্যাস থেকে এই ছবির ভাবনা। ‘স্পটলাইট’ অনেক কিছু নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে তার এক ঘণ্টার মধ্যে। ‘স্পটলাইট’-এ অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় আর রুদ্ররূপ মুখোপাধ্যায়ের আলোচনায় খুঁজে পাওয়া যায়, হারিয়ে যাওয়া বাংলার ব্রডওয়ের কথা। কী ভাবে ১৮৩৫ সালের বাবু নবীনচন্দ্রের ম্যানসন থেকে যে অদ্ভুত এক যাত্রা শুরু হয়েছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, তা কী ভাবে পাল্টেছে, গড়েছে, ভেঙেছে— সে কথা উঠে এসেছে তাঁদের আলোচনায়।
‘দ্য ফায়ারবার্ড’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যেহেতু এই কাজ, তাই উপন্যাসে আলোচিত তৎকালীন সমাজ, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও থিয়েটার কেন্দ্রিক অসহনীয়তার কথা স্বাভাবিক ভাবেই স্থান পেয়েছে এই ছবিতে। মহিলাদের অভিনয় করা থেকে শুরু করে তথাকথিত ‘খারাপ মেয়ে’দের অভিনয়ের জগতে আসা এবং সামাজিক মূল্যবোধ থেকে তাকে মেনে নেওয়া বা না-নেওয়ার যে দ্বন্দ্ব, এই সব কিছুই সুচারু ভঙ্গিতে কথোপকথনের মাধ্যমে ছবিতে রেখেছেন সুজয়প্রসাদ।
এর পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ‘পপুলার’ থিয়েটারের মঞ্চ, যেমন প্রতাপ মঞ্চ, কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ, বিশ্বরূপা, রংমহলের কথা আসে ছবিতে। কথা ওঠে মিনার্ভা, ক্লাসিক, স্টার থিয়েটারেরও। কী ভাবে থিয়েটার জগৎ গিরিশ ঘোষ প্রমুখের নেতৃত্বে পাবলিক থিয়েটার এল সামনের সারিতে, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে ক্রমে পুরোদস্তুর গ্রুপ থিয়েটারের দিকে পদার্পণ করল, এই সবও জানায় এই ছবি।
চলচ্চিত্র জগতের অভিনেতাদের থিয়েটারে আসা, এবং পরবর্তীকালে ১৯৮০ নাগাদ থিয়েটারে ক্যাবারের ব্যবহার, থিয়েটারের মানের পতন এবং অন্যদিকে গ্রুপ থিয়েটারে রাজনৈতিক প্রযোজনার উত্থান— থিয়েটারের মধ্যে দিয়ে চলেছে একের পর এক স্রোত, যা বার বার পাল্টে দিয়েছে থিয়েটারের বাসভূমিকে, ক্ষেত্রকে।
রত্না ঘোষাল সেই সময়ের আলোড়ন ফেলা নাটক ‘নহবৎ’ এর কিছু অংশ পড়ে শোনান, যা দর্শকদের কাছে নিঃসন্দেহে এক বাড়তি পাওনা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও পৌলমী বসুর ‘নীলকন্ঠ’ নাটক থেকে পাঠ, রংমহলের হাউসফুল শোয়ের কথা মনে পড়াবে দর্শককে।
দামিনী বসুর ‘বারবধূ’ নাটকের গান দিয়ে এই ছবির সমাপ্তি। আর সেই গানের এমন ব্যবহারের জন্য ছবির নির্মাতাদের অবশ্যই কৃতিত্ব প্রাপ্য। দর্শকের মধ্যে এই গানের রেশ ছবির পরেও অনেকক্ষণ রয়ে যাবে।
ছবিটির নির্মাণের পুরোটাই লকডাউন চলাকালীন। যার ফলে কিছু সমস্যা বা ত্রুটি থেকে গিয়েছে। মূলত শব্দ রেকর্ড করার কিছু সমস্যার কারণে কিছু সংলাপ অস্পষ্ট থেকে গিয়েছে। আরও বহু মানুষের সাক্ষাৎকার থাকলে, এই কাজ আরও সমৃদ্ধ হত। এ কথা সুজয়প্রসাদ নিজেই স্বীকার করেছেন প্রদর্শনের পূর্বেই। তা সত্ত্বেও যে কথা না বললেই নয়, ছবিটির এই আকাঁড়া ভাবটিই ছবিটিকে আরও সৎ করে তুলেছে। কারণ থিয়েটারের জগৎ নিয়ে যে ছবির কাজ, সেই ছবি যদি খুব বেশি পালিশ করা হয়, তা হলে কোথাও গিয়ে তাতে থিয়েটারের গন্ধ আর থাকে না।
‘স্পটলাইট’ শেষ হয় তপন থিয়েটারে এসে, মঞ্চ এবং দর্শকাসনের মধ্যে দাঁড়িয়ে কোথাও গিয়ে ছবিটি একাত্ম করে দেয় সব কিছুকে— এটাই থিয়েটার। ‘স্পটলাইট’-এ থাকে সব কিছু, সেখানে কে দর্শক, কে শিল্পী, সে সব জানার কোনও প্রয়োজন নেই— সবটাই থিয়েটার। কখনও নবীন, আবার কখনও প্রাচীন, বটগাছসম। যে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, ছায়া দেয়, আশ্রয় দেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy