‘পাটালীগঞ্জের পুতুলখেলা’ ছবির একটি দৃশ্যে সোহম মজুমদার এবং দিতিপ্রিয়া রায়। ছবি: সংগৃহীত।
ঘরে ঘরে পাটালিগুড়ের গন্ধের সময় এখন। তার মধ্যেই আস্ত পাটালীগঞ্জের গল্প নিয়ে হাজির এক পুতুলখেলা, থুড়ি ছবি। মনে পড়ে, বহু দিন আগে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় প্রশ্ন তুলেছিলেন, মানুষ পুতুলকে নাচায়, না কি মানুষই বিধাতার হাতের পুতুল? অবশ্যই সে প্রশ্ন দার্শনিক। কিন্তু ‘পাটালীগঞ্জের পুতুলখেলা’ দেখতে দেখতে হাসির ছলেই উঠে এল সেই প্রশ্নটিই। অর্থাৎ, মানুষই কি তা হলে পুতুল?
পরান বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবীণ বাবা এ ছবিতে। সাম্প্রতিক অনেক ছবির মতোই পরানকে সেই অসহায় প্রবীণ বাবার ভূমিকায় এ ছবিও দেখতে চায়। তাঁর টালির চালের বাড়ির দিকে নজর স্থানীয় নেতা (রজতাভ দত্ত অভিনীত)-র। এ দিকে বাড়িতে তাঁর পুত্র পুতুলখেলা দেখিয়ে শিল্পী হতে চায়। কিন্তু তার তেমন আয় না থাকায় বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। এ হেন পটভূমিকায় শুরু হয় রাজনীতির খেলা। গুরুর আশীর্বাদে ছেলের বিয়ে হয়। এই বিয়েকে ঘিরেই স্থানীয় নেতারা নেমে পড়ে নিজেদের আখের গোছাতে। বাড়ি দোতলা করার স্বপ্নে বাবার প্রশ্রয়ে ঘটে যায় এই ঘটনা। বাড়ি আর সমাজের রাজনীতির এই দোটানা কী ভাবে জড়াতে থাকে, তার জন্য দেখতে হবে ছবিটি।
বাংলা ছবির বাজারে সহজ-সরল হাসির ছবির খুবই আকাল। সে দিক দিয়ে এ ছবি অবশ্যই ব্যতিক্রমী। সাম্প্রতিক রাজনীতির নানা স্তর চিত্রনাট্যের আনাচকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। সে রাজনীতি শুধু এ রাজ্যের আগের জমানার সরকারকে ঘিরেই নয়, বর্তমান সরকারের নানা সমালোচনাও করে এ ছবির আখ্যান। সমালোচনা করে মিডিয়ার ভূমিকারও। তাই অজান্তেই ‘খাস খবর’ এখানে ‘বাঁশ খবর’ হয়ে যায়। সঞ্চালনায় থাকেন মীর। মনে পড়ে, এ ছবির পরিচালক শুভঙ্কর চট্টোপাধ্যায়-সহ পরান-রজতাভ-মীরকে বাংলা টিভিতে নিয়মিত দেখা যেত ‘মীরাক্কেল’ অনুষ্ঠানে। এ ছবিও যেন তারই অন্য রকম সম্প্রসারণ। এ ছাড়া মূল চরিত্রে ছোট পর্দা থেকে উঠে আসা সোহম মজুমদার বা দিতিপ্রিয়া রায়ের পাশাপাশি শাশুড়ির ভূমিকায় তনিমা সেনকে অনেক দিন পর দেখে ভাল লাগে।
ঘরের রাজনীতি আর বাইরের রাজনীতি একাকার হওয়ার কথাই বলে এ ছবি। মজার ছলেই বলে। আসলে বলে, ঘরের লোকেরা এক থাকলে বাইরের লোকেরা ঘরে ঢোকে না। আর তাই, আরজি কর আন্দোলনের ছায়ায় ছবির শেষেও দেখি এলাকার মানুষ এক হয়ে কোণঠাসা করে দিয়েছে নেতাদের। এই প্রবল বিচ্ছিন্নতাবাদের সময়ে, যখন মানুষ কেবল সমাজ বা পরিবার থেকেই নয়, নিজের থেকেও বিচ্ছিন্ন, তখন এই ঐক্য অন্য বার্তা দেয়। তাই ছবির শেষে পরান যখন বোঝেন, খুড়োর কলের মতো তাঁর টালির চাল পাকা করার লোভে পা না দিলে যৌথ পরিবারের ভাঙত না, তখন অনুতপ্ত হন।
তবে ছবিটি দেখতে দেখতে কিছু ধন্দও তৈরি হয়। ‘মীরাক্কেল’ দেখে বড় হয়েছে আস্ত একটা প্রজন্ম। সমকাল নিয়ে নানা হাসি-ঠাট্টা-মশকরাই থাকত সেখানে। এবং তার পরিবেশনও ছিল স্মার্ট। এ ছবি যখন সে শোয়ের পরিচালক আর বড় অংশের অভিনেতাদের হাতেই বানানো, তখন আশা জাগে, তেমনই কিছু ‘স্মার্ট’ ঝলক দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু ছবিটি যত এগোতে থাকে, তত জোর করে হাসানোর চেষ্টা বড় বেশি চোখে পড়ে। কেন এমন হল? কোথাও কি মগজাস্ত্রে শান দেওয়া দর্শককুলের উপর থেকে আস্থা উঠে গেল ছবির নির্মাতাদের? না কি বাংলা ছবির বাজারের সাম্প্রতিক দুরবস্থা দেখে কিছুটা সহজ চটুল রাস্তা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন নির্মাতারা? কারণ, বুড়ো বাবার দুরবস্থা নিয়ে বাংলায় ছবির সংখ্যা তো নেহাত কম নয়! তাই আর একটু স্মার্ট কি হতে পারত না গোটা আখ্যান? বা দিতিপ্রিয়া অভিনীত চরিত্রটির ডিভোর্স কি সত্যিই আজকের দিনে গ্রামের পরিবারেও কোনও সমস্যা? এমনকি, মেয়েটির পরিবারের গ্রামটির সঙ্গেও আজকের গ্রামের বিস্তর ফারাক। তাই এ দিকগুলোয় আর একটু আলো পড়লে ভাল হত।
কেন পড়ল না, জানা নেই। তবে বাংলা ছবির বাজারের এই গোমড়ামুখো আকালে আর একটা হাসির ছবি দেখতে মন্দ লাগবে না বলেই বিশ্বাস। হোক না তা কিছুটা সেকেলে, কিছুটা লঘু, চটুল। শীত প্রায় শেষ হয়ে এল। উৎসবের মরসুমের শেষ লগ্নে বিনা পয়সায় খানিক ক্ষণ হাসার এই সুযোগ ছাড়া কাজের কথা নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy