পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘কেনেডি’ দেখার এমন উন্মাদনা ছিল যে, বন্ধ করে দিতে হয়েছিল নন্দনের দরজা। এ বার ফের কলকাতায় এলেন অনুরাগ কাশ্যপ। এ বারও সেই নন্দন, রয়েছে তাঁর ছবি ‘কেনেডি’ও। ফরাসি চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম বছরে প্রদর্শিত হল অনুরাগের এই ছবি। তবে উন্মাদনা এ বার খানিকটা কম। তবু কলকাতায় ফিরে আসতে ভাল লাগে তাঁর। হাতে সময় অল্প। তার ফাঁকেই বাংলা সিনেমা থেকে নিজের শেষ ছবি, বলিউডের সাম্প্রতিক ট্রেন্ড থেকে সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গা, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজের ইচ্ছা— সব নিয়েই আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে আড্ডা দিলেন পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ।
প্রশ্ন: কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘কেনেডি’ নিয়ে উন্মাদনা ছিল। এ বার কেমন লাগছে?
অনুরাগ: গত বার অনেকে দেখতে পাননি ছবিটা। আশা করব, এ বার যেন তাঁরা দেখতে পান। আসলে গত বার যাঁরা দেখতে পাননি তাঁদের জন্য আমার ভীষণ অপরাধবোধ হচ্ছিল।
প্রশ্ন: গত বার আপনার ছবির প্রদর্শনীতে লাঠিচার্জ হয়, দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমন উন্মাদনা দেখলে পরিচালক হিসেবে কেমন অনুভূতি হয়?
অনুরাগ: পরিচালক হিসেবে আমার সব সময় একটাই জিনিস মনে হয়, কত বেশি সংখ্যক দর্শকের কাছে ছবিটা পৌঁছতে পারল। আর কলকাতার দর্শকদের কাছে থেকে বরাবরই ভালবাসা পেয়ে এসেছি আমি।
প্রশ্ন: ২০২৩ সালে বলিউডে বড় বাজেট, বড় তারকাদের ছবি রমরমিয়ে চলেছে বক্স অফিসে। ১০০০ কোটির নীচে রোজগার হলে ছবিকে সফল ধরা হচ্ছে না। কি মনে হয়, দর্শক বদলে গিয়েছেন না কি ব্যবসার ধরন?
অনুরাগ: (এক মুহূর্ত না ভেবে) সিনেমায় ব্যবসার ধরন বদলে গিয়েছে। এটার ভালমন্দ দুটো দিক আছে। ভাল দিক হল বড় বড় ছবি বৃহত্তর ইন্ডাস্ট্রির জন্য অর্থ আনতে পারছে, ব্যবসায়িক সাফল্য পাচ্ছে। খারাপ দিকটা হল একটা নির্দিষ্ট ঘরানার সিনেমা ও তাঁদের পরিচালকদের জন্য কোনও জায়গা রইল না। তবে গত বছর বিধু বিনোদ চোপড়ার মতো পরিচালকের প্রত্যাবর্তন হল। সেটাও তো একটা ভাল দিক।
প্রশ্ন: আপনি ‘অ্যানিম্যাল’ ছবিটিকে ২০২৩ সালের ‘গেম চেঞ্জার’ কেন বললেন?
অনুরাগ: ‘গেম চেঞ্জার’ শব্দটা সব সময় যে পজ়িটিভ ভাবেই দেখতে হবে তেমনটা নয়। আমরা কাছে এর দু’টি দিকই রয়েছে। আসলে সিনেমা ব্যবসার ধরনটা বদলে যেতে সকলেই এখন ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রই করতে চাইছেন।
প্রশ্ন: সিনেমার ব্যবসার মতো বিভিন্ন পুরস্কারের ধরনও কি বদলেছে?
অনুরাগ: আমি বলিউডের অ্যাওয়ার্ড শোয়ে যাই না, তাই ভাবিও না। আসলে পুরস্কার দিয়ে ছবি কিংবা জুরির বিচার করা যায় না। পুরস্কারগুলো জুরিতে যাঁরা থাকেন, তাঁদের মতোই।
প্রশ্ন: চলচ্চিত্র উৎসবের জুরির উপরও কি তা হলে আপনার বেশি আস্থা?
অনুরাগ: আসলে জুরি সব সময়েই পুরস্কারের পক্ষে থাকেন। তাই একটা ছবি পুরস্কার না পেলে সেটা বাজে ছবি হয়ে গেল, তেমন ভাবার দরকার নেই। আবার পুরস্কার জিতল মানেই সেটা দুর্দান্ত ছবি, সেটা ভাবারও কারণ নেই।
প্রশ্ন: ‘অ্যানিম্যাল’, ছবিটা দু’বার দেখেছেন। কী কারণে আপনার এতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করল এই ছবি?
অনুরাগ: কোনও ছবির মান ও মেধা নিয়ে সেই ছবির পরিচালকের সঙ্গেই আমি কথা বলি। আসলে আমি প্রতি দিনই অনেক ছবি দেখি। কিন্তু কোনও ছবি ৪০ দিন ধরে ভাবতে বাধ্য করে না। এখন সমাজমাধ্যমের যুগে ছোটখাটো সব বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য লোক রয়েছে। সিনেমার রেটিংয়ের ভিত্তিতে তার সাফল্যের মাপকাঠি নির্ধারিত হয়, এটা কি ঠিক! আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি ,যখন কে যে কী করছে বুঝতে পারছি না। চারদিকে ‘ট্র্যাজিক কমেডি’ চলছে।
প্রশ্ন: সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গার সঙ্গে ছবি দিয়ে ওঁর প্রশংসা করায় বরুণ গ্রোভর বা বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানের মতো আপনার বন্ধুরা আপনার সঙ্গে সহমত হননি।
অনুরাগ: হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু আমি আসলে এত কিছু ভাবি না। বেশি ভাবলে আমি শেষ হয়ে যাব। আমার যেটা ভাল লাগে আমি সেটা করি, সেটা করতে কখনও লজ্জা পাই না। কাউকে প্রশংসা করতেও পিছপা হই না।
প্রশ্ন: ‘অ্যানিম্যাল’ ছবি পর উগ্র পৌরুষ নিয়ে চারপাশে যে চর্চা হচ্ছে তাঁকে আপনি সাধুবাদ জানান। কিন্তু কোনও বিষয়কে সমাজের কাছে তুলতে গিয়ে চিত্রায়নের দিকটায় কি পরিচালকের নজর দেওয়ার প্রয়োজন নেই?
অনুরাগ: আমি কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সেই নিয়ে ভাবছি না। কিন্তু কথা হচ্ছে তো। কার জন্য আলোচনা-চর্চা হচ্ছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেক ফালতু বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করি। তবে দেখুন, সমাজের একটা বড় অংশ, ভারতের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ দর্শক ‘অ্যানিম্যাল’ দেখে দারুণ আনন্দ পেয়েছেন। তা হলে সকলে মিলে একটা মানুষের মধ্যেই কেন সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন? যাঁরা এই ছবি দেখছেন, তাঁদের মধ্যেও সমস্যা রয়েছে। এত বড় তারকারা কাজ করেছেন, তাঁদের কোনও দায় নেই? সমস্যা তা হলে তাঁদেরও আছে। যে কোনও একটা মানুষকে টার্গেট করা সেটা ঠিক নয়। আমি সেই মানসিকতায় সমস্যা দেখতে পাই।
প্রশ্ন: আপনি কি সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গার প্রতি সহানুভূতিশীল?
অনুরাগ: এটা ভীষণ কঠিন প্রশ্ন! (খানিক ভেবে) আমি সব থেকে খারাপ মানুষটার প্রতিও সহানুভূতিশীল। সন্দীপ এবং তাঁর মাথায় কী চলে তা নিয়ে খুব উৎসাহী ছিলাম। ছবিটা দেখার পর ভীষণ কৌতহূল হচ্ছিল ওঁর চিন্তা-ভাবনা নিয়ে। সেটা কে পূরণ করবেন? যিনি পরিচালক, তিনিই। তাই ওঁর কাছেই গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: এক জন পরিচালকের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকা উচিত, না কি ছবির ব্যবসায়িক সাফল্যই শেষ কথা?
অনুরাগ: শুধু পরিচালকেরই কেন দায়বদ্ধতা থাকবে? সেই পেশায় যাঁরা রয়েছেন, সবাইকে সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে! দেখুন, বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে গিয়ে আমি এমন কিছু কথা বলে ফেলি, তার পর আমাকে ‘ক্যানসেল’ করে দেওয়া হয়। আমি আর ও দিকে পা দিচ্ছি না।
প্রশ্ন: আপনাকে যখন বার বার ‘ক্যানসেল’ করা হয়, কী ভাবে ঘুরে দাঁড়ান?
অনুরাগ: যাঁরা ভাল পরিচালক, তাঁরা সমাজকে উস্কানি দেবেন। সমাজ তাঁদের বাতিলও করবে। কেন সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বলা হত তিনি ‘পভার্টি পর্ন’ (দারিদ্র্যকে বিক্রি করা) বিক্রি করে ছবি সফল করতেন। পিয়ের পাওলো পাসোলিনি ধর্মাচরণের বিরুদ্ধে ছবি করায় কুপিয়ে খুন করা হয়।
প্রশ্ন: আপনি বিভিন্ন সময় হিন্দু কট্টরপন্থীদের রোষের মুখে পড়েছেন। দেশ ছেড়ে কিছু দিন বিদেশে কাটাতে হয়। এই ঘটনাগুলো আপনার মধ্যে কি পরিবর্তন এনেছে?
অনুরাগ: আসলে আমি গত ২০ বছর ধরে টার্গেট হচ্ছি। ...পরিবর্তন জানি না। সারা বিশ্বেই আসলে এগুলো হচ্ছে। আপনি দেশের বাঁ দিকে যান কিংবা ডান দিকে— চিত্রটা কমবেশি এক। হয় আপনি মানিয়ে নিন, নয়তো রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করুন। দেখুন সবাই আগে নিজের পিঠ বাঁচাতে চান। পেটে তিন বেলা ভাতের দরকার, চুপ করে থাকার এটাই সবচেয়ে বড় কারণ।
প্রশ্ন: এই মুহূর্তে দেশে সব থেকে চর্চিত বিষয় রামমন্দির…।
অনুরাগ: (থামিয়ে দিয়ে) এই বিষয়ে কোনও উত্তর দিতে চাই না।
প্রশ্ন: আপনার জীবনের কোনও আক্ষেপ রয়েছে?
অনুরাগ: আক্ষেপ নিয়ে বাঁচা সম্ভব নয়। তাই কোনও আক্ষেপ নেই আমার।
প্রশ্ন: জীবনে সাফল্য ও ব্যর্থতা— দুটোই কী ভাবে সামলান?
অনুরাগ: আমি তো জীবনে কখনও সফল হইনি। ব্যর্থতা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত। প্রথম সাত বছরই নিষিদ্ধ ছিলাম। কখনওই আমার ছবি বক্স অফিসে দারুণ কিছু কামাল করেনি। তাই ব্যর্থতা সামালানোর অভ্যাস রয়েছে। সফল যে দিন হয়ে যাব, সে দিন বুঝতে পারব না কী ভাবে সামলাব সবটা।
প্রশ্ন: আপনার নিজস্ব একটা ব্র্যান্ড হয়েছে এত বছরে। সেটা কি অস্বীকার করবেন?
অনুরাগ: নাম আর ব্র্যান্ড তো লোকে বানিয়ে দেন। সেটার আলাদা খেসারত দিতে হয়।
প্রশ্ন: অনুরাগ কাশ্যপের মনখারাপ হলে কী করেন?
অনুরাগ: শুধু ঘুমোই।
প্রশ্ন: বাংলা সিনেমা দেখেন?
অনুরাগ: না, দেখা হয় না। বাংলা সিনেমায় এখন ভীষণ রকম তামিল-তেলুগু ছবির প্রভাব। শুধু বাংলা নয়, হিন্দি ছবিতেও দক্ষিণের প্রভাব ভীষণ রকম। আসলে বাংলায় এমন কিংবদন্তী সব পরিচালক ছিলেন, তাঁর জয়জয়কারটাও তাই বেশি ছিল। তেমনই পতনের সময় আওয়াজটাও বেশি। খানিকটা এভারেষ্ট থেকে পড়ার মতো।
প্রশ্ন: শেষ কোনও বাংলা ছবি দেখেছেন?
অনুরাগ: শেষ আমি ‘পদাতিক’ দেখেছি। তার মানে এই নয় যে, বহু বছর আগে দেখেছি। কিছু ছবির কাছে বার বার ফিরে যাই। ‘পদাতিক’ তেমনই একটা ছবি।
প্রশ্ন: আপনি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কাজ দেখেছেন?
অনুরাগ: (খানিক ভেবে) ওহ্ বুম্বাদা! প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলতে আমি খানিক বুঝতে পারিনি। বুম্বাদা’র সঙ্গে কাজ করব আমি কথা দিয়েছি। বিক্রমাদিত্যর (মোটওয়ানে) সঙ্গে উনি ‘জুবিলি’-তে কাজ করেছেন। এ বার আমার কথা রাখার পালা।
প্রশ্ন: আপনার শেষ ছবি কী হবে?
অনুরাগ: কোনও শেষ ছবি হবে না। ছবি বানাতে বানাতেই সেটেই মরতে চাই, এটাই একটা পরিচালকের স্বপ্ন। মরলে সেটেই মরব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy