সেই অবিস্মরণীয় জুটি। সলিল চৌধুরী এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে
গাঁয়ের বধূ (১৯৪৯)
কথা ও সুর: সলিল চৌধুরী
কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো
রূপকথা নয় সে নয়।
জীবনের মধুমাসের কুসুম-ছেঁড়া-গাঁথা মালা
শিশির-ভেজা কাহিনি শোনাই শোনো।
একটুখানি শ্যামল-ঘেরা কুটিরে তার স্বপ্ন শত শত
দেখা দিত ধানের শীষের ইশারাতে
দিবাশেষে কিষান যখন আসত ফিরে
ঘি মউ মউ আম-কাঁঠালের পিঁড়িটিতে বসত তখন,
সবখানি মন উজাড় করে দিত তাতে কিষানি
সেই কাহিনি শোনাই শোনো।
ঘুঘু ডাকা ছায়ায় ঢাকা গ্রামখানি কোন মায়াভরে
শ্রান্তজনে হাতছানিতে ডাকত কাছে আদর করে সোহাগ ভরে
নীল শালুকে দোলন দিয়ে রংফানুসে ভেসে
ঘুমপরি সে ঘুম পাড়াত এসে কখন জাদু করে
ভোমরা যেত গুনগুনিয়ে ফোটাফুলের পাশে।
আকাশে বাতাসে সেথায় ছিল পাকা ধানের বাসে বাসে সবার নিমন্ত্রণ।
সেখানে বারো মাসে তেরো পাবন আষাঢ় শ্রাবণ কি বৈশাখে
গাঁয়ের বধূর শাঁখের ডাকে লক্ষ্মী এসে ভরে দিত
গোলা সবার ঘরে ঘরে।
হায়রে কখন এল শমন অনাহারের বেশেতে
সেই কাহিনি শোনাই শোনো।
ডাকিনী যোগিনী এল শত নাগিনী
এল পিশাচেরা এল রে।
শত পাকে বাঁধিয়া নাচে তাথা তাথিয়া
নাচে তাথা তাথিয়া নাচে রে।
কুটিলের মন্ত্রে শোষণের যন্ত্রে
গেল প্রাণ শত প্রাণ গেল রে।
মায়ার কুটিরে নিল রস লুটি রে
মরুর রসনা এল রে।
হায় সেই মায়া-ঘেরা সন্ধ্যা
ডেকে যেত কত নিশিগন্ধা
হায় বধূ সুন্দরী
কোথায় তোমার সেই
মধুর জীবন মধুছন্দা।
হায় সেই সোনাভরা প্রান্তর
সোনালি স্বপনভরা অন্তর
হায় সে কিষানের কিষানির জীবনের
ব্যথার পাষাণ আমি বহি রে।
আজও যদি তুমি কোনো গাঁয়ে দেখো ভাঙা কুটিরের সারি।
জেনো সেইখানে সে গাঁয়ের বধূর
আশা-স্বপনের সমাধি।
শিল্পবাণিজ্যের পরিভাষায় ‘গেম চেঞ্জার’ বলে একটা কথা আছে। নাগরিক বাঙালির শ্রবণবিশ্বে ‘গাঁয়ের বধূ’ গানটা তাই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সলিল চৌধুরীর যুগলবন্দি ছাড়া আধুনিক বাংলা গানের সোনালি ফসল যে আমাদের ঘরে উঠত না এ কথা হলফ করেই বলা যায়। এর যুগলবন্দির সূচনাবিন্দুতে আছে সাড়ে ছ’মিনিটের এই গানটা। গণ আন্দোলনের ময়দান থেকে বেরিয়ে আসা পথ কী ভাবে মনোরঞ্জনী সংস্কৃতির চোরা বাঁকে এসে ফুল ফোটাতে পারে তারও সার্থক উদাহরণ ‘গাঁয়ের বধূ’।
সত্যি বলতে কি, একটা গানের মধ্যে যুগলক্ষ্মণ ফুটে ওঠার পাশাপাশি কী ভাবে যুগযন্ত্রণাও ফেটে বেরোতে পারে, ‘গাঁয়ের বধূ’ শোনার আগে বাঙালি জানত না। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা জুড়ে যে দুর্ভিক্ষ হয়, যাকে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ বলা হত আগে, যাকে ‘চার্চিলস সিক্রেট ওয়র’ বলার চল হয়েছে এখন, তাতে অন্তত ৫০ লক্ষ বাঙালির মৃত্যু হয়। ওই দুর্ভিক্ষ কী ভাবে বাংলার কৃষি অর্থনীতির ভিত চুরমার করে দিয়েছিল, তার ‘ব্যথার পাহাড়’ বয়ে এ গান তৈরি করেছিলেন সলিল চৌধুরী।
হেমন্তর গলায় এই গান রেকর্ড হওয়ার একটা ছোট ইতিহাস আছে। ১৯৪৫-এর ৭ ডিসেম্বর বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় হেমন্তর। ভবানীপুরের বাসার কাছেই, ইন্দিরা সিনেমার উল্টো দিকে ইন্দ্র রায় রোডে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলেন তাঁরা। পূর্ব পরিচয়ের খেই ধরে এই বাড়িতেই হেমন্তকে ‘গাঁয়ের বধূ’ শোনাতে এসেছিলেন ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সক্রিয় গণশিল্পী সলিল। তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন ভূপতি নন্দী। পরে হেমন্ত বলছেন,
‘সলিল এল। সলিলও তখন আইপিটিএ-র সঙ্গে যুক্ত। নতুন নতুন সুর করে। সেই সুরের গান আইপিটিএ-র ফাংশান স্কোয়াডই এখানে ওখানে গেয়ে বেড়ায়। গ্রামাফোন কোম্পানিতে তখনও চান্স পাচ্ছিল না সলিল।
আমাদের বাড়িতে এসে অনেকগুলো গান শোনাল সলিল। সবই প্রোগ্রেসিভ গান। কোরাস ভাল হয়। কিন্তু সোলো রেকর্ড করা মুশকিল। চলবে না। সলিলকে সেই কথাই বললাম।
দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এল সলিল। বললে, হেমন্তদা, একটা অন্য ধরনের গানেরও সুর করেছি। আমারই লেখা। অবশ্য এখনও পুরোটা লেখা হয় নি। তা যেটুকু হয়েছে শোনাব?
বললাম, হ্যাঁ, শোনাও। সলিল শোনাল – কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমার শোনাই শোনো, রূপ কথা নয় সে নয়।
শুনলাম। ভালও লাগল। বললাম, এটা হতে পারে। তবে এ-গানটাকে আরও বাড়াতে হবে। কাহিনী-সংগীত যখন, রেকর্ডের দু’পিঠের মতো কথা বাড়াও। তাহলে খুব ভাল হবে।
আমার কথায় উৎসাহ পেল সলিল। বাড়িয়ে ফেলল গানটাকে। দু’দিন পরে এসে আবার শোনাল। মন দিয়ে শুনলাম। শুনে বললাম, হয়েছে। খুব ভাল হয়েছে। আমি রেকর্ড করব।’ (আনন্দধারা, পৃষ্ঠা ৪৩-৪৪)।
আরও পড়ুন: রঙিন ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে বিতর্কে সত্যজিৎপ্রেমীরা
পঞ্চাশের মন্বন্তরের এই নাড়ি ছেঁড়া ধন ৭৮ আরপিএমের দুটো চাকতিতে ঢুকে এক লহমায় পৌঁছে গিয়েছিল সুখী গৃহকোণের টার্ন টেবলে। ছবি:সংগৃহীত
তখন হেমন্ত যে গানই রেকর্ড করছেন তার দারুণ কাটতি। হু হু রেকর্ড বিকোচ্ছে। গ্রামাফোন কোম্পানির কাছে দর বাড়ছে। ‘কথা দাও তোমার মালা করবে আমায় দান’ কলেজের ছেলেমেয়েরা এ ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে গাইছে। ফলে হেমন্তের সুপারিশের তখন দাম ছিল। তবু গ্রামোফোন কোম্পানি ‘গাঁয়ের বধূ’ রেকর্ড করার ব্যাপারে দোনামোনায় ছিল। কথা উঠেছিল, এ সব পাঁচালি কে শুনবে? কে কিনবে? বেগতিক দেখে মধ্যস্থতা করেন গণনাট্য সঙ্ঘের রাজ্য কমিটির সদস্য তথা কোম্পানির রেকর্ডিং-ইন-চার্জ ক্ষিতীশ বসু। ও দিকে কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে পুরো গানখানা হেমন্তর হাতে তুলে দেবার পরপরই পুলিশের খানাতল্লাশি এড়াতে গা ঢাকা দিতে হয় সলিলকে। সলিলের অবর্তমানে তাঁর শেখানো সুরে, তাঁরই ছকে দেওয়া যন্ত্রানুসঙ্গে ‘গাঁয়ের বধূ’ রেকর্ড করেন হেমন্ত। কিছু দিনের মধ্যেই এইচএমভি-র শারদ অর্ঘ্যে ঠাঁই হয় ‘গাঁয়ের বধূ’র। তার পর যা হয়েছিল তা তো ইতিহাস! পঞ্চাশের মন্বন্তরের এই নাড়ি ছেঁড়া ধন ৭৮ আরপিএমের দুটো চাকতিতে ঢুকে এক লহমায় পৌঁছে গিয়েছিল সুখী গৃহকোণের টার্ন টেবলে।
আরও পড়ুন: নির্দেশ সত্ত্বেও সুনসান স্টুডিয়ো পাড়া, সুরক্ষাবিধি মেনে শুটিং শুরু হতে পারে সপ্তাহের শেষে
আর সলিল? সলিল এ গান শুনেছিলেন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ থেকে। সন্দেশখালিতে পার্টির গোপন ডেরায় বসে। এই সাফল্যে তিনি উল্লসিত হলেও তাঁর কমরেডরা হননি। গণনাট্য সঙ্ঘের যে সব সর্বভারতীয় সম্মেলনকে ‘আমার সংগীতের বিশ্ববিদ্যালয়’ বলতেন সলিল, সেই গণনাট্য সঙ্ঘের আসরে এ গান নিষিদ্ধ হয়েছিল। ক’ বছর বাদে বেরনো ‘পালকির গানে’র গায়ে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ মোহর লাগানো হয়েছিল। কেন? তার বাকি ইতিহাস আজও কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy