(বাঁ দিক থেকে) শ্রীলেখা মিত্র, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, মমতা শঙ্কর, তসলিমা নাসরিন এবং রত্নাবলী রায়। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
ইদানীং সমাজমাধ্যমে চোখ রাখলে ‘রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট’ বা ‘শাড়ির আঁচল’ বা ‘বুকে শাড়ির আঁচল’-এর মতো শব্দবন্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এই বিষয়ে সমাজমাধ্যমে কথা বলেছেন টলিপাড়ার স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্র, রূপাঞ্জনা মিত্র থেকে শুরু করে লেখক তসলিমা নাসরিন পর্যন্ত।
নববর্ষের নতুন সাজ বা আসন্ন নির্বাচনের সাজ নিয়ে আলোচনার বাইরে হঠাৎ উঠে এল ‘বুকের আঁচলখানি’। কেন?
এর নেপথ্যে রয়েছে টলিপাড়ার বর্ষীয়ান অভিনেত্রী মমতা শঙ্করের একটি মন্তব্য। সম্প্রতি আনন্দবাজার অনলাইনে অভিনেত্রীর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ওই সাক্ষাৎকারে বর্ষীয়ান অভিনেত্রীর কিছু বক্তব্য নিয়ে দানা বেঁধেছে বিতর্ক। টলিপাড়ার একাধিক ব্যক্তিত্ব এই প্রসঙ্গে সমাজমাধ্যমে অভিনেত্রীর পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত জানিয়েছেন।
আনন্দবাজার অনলাইনের সাক্ষাৎকারে কী বলেছিলেন মমতা শঙ্কর? তাঁর সামনে প্রশ্ন রাখা হয়, নতুন প্রজন্মের নারীদের সাজ নিয়ে তাঁর কী ভাবনাচিন্তা? উত্তরে অভিনেত্রী বলেন, ‘‘আজকাল শাড়ি পরব, কিন্তু আঁচল ঠিক থাকবে না! ঠিক বুঝতে পারি না। আগে যাঁদের আমরা রাস্তার মেয়ে বলতাম, যাঁরা ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁরা ওই ভাবে দাঁড়াতেন।’’ এরই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘গ্রামে মহিলাদের কাজ করতে গিয়ে হয়তো আঁচল সরে যেত। তাতে কোনও দোষ ছিল না। আর ওঁরা (যৌনকর্মী) তো পেশার তাগিদে পুরুষদের আকর্ষণ করার জন্য ও ভাবে শাড়ি পরে থাকেন।’’ অভিনেত্রীর এই বক্তব্য নিয়েই দানা বেঁধেছে বিতর্ক।
অথচ তিনি কিন্তু পরে তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তিও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি তাঁদের শ্রদ্ধা করি। কিন্তু এখন যাঁরা বিনা কারণে আঁচল নামিয়ে শাড়ি পরেন, তার প্রতিবাদ করি। লোকে কিছু বললে তাঁরা রেগে যান। বলেন মেয়েদের নিচু করা হচ্ছে। আসলে তো আমরা মেয়েরাই মেয়েদের নিচু করছি।’’
লেখিকা তসলিমা নাসরিন এই প্রসঙ্গে ফেসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্ট করেছেন। তিনি লেখেন, ‘‘আমি কখনও শাড়ির আঁচল বুকের মাঝখান দিয়ে নিই না। বক্ষযুগলের ওপরেই থাকে আমার শাড়ির আঁচল। কিন্তু বক্ষযুগলকে আঁচল দিয়ে যারা আড়াল করতে না চায়, তাদের এই না-চাওয়াকে কেন অশালীন বলা হবে? কোন যুক্তিতে?’’ শাড়ি হোক বা বোরখা, তিনি যে মহিলাদের পোশাকের উপর কিছু চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধী তা নিজের লেখায় স্পষ্ট করেছেন তসলিমা। মমতা শঙ্করের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, ‘‘বাংলার নামী নৃত্যশিল্পী এবং অভিনেত্রী মমতা শঙ্কর মেয়েদের শালীনতা বজায় রাখতে বলেছেন, তা না হলে পুরুষেরা মেয়েদের খারাপ ভাববে— এই যুক্তি দিয়ে। যে পুরুষেরা মনে করে মেয়েদের শালীনতা নির্ভর করে মেয়েরা কাপড়চোপড় দিয়ে শরীর কতটা ঢাকল তার ওপর, সেই পুরুষদের তিরস্কার না করে মমতা শঙ্কর তিরস্কার করছেন মেয়েদের। তিরস্কার করে তিনি যে পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক— সেটাই প্রমাণ করলেন। শুনেছি তিনি সমকামিতাকে, এবং রূপান্তরকামিতাকেও তিরস্কার করেন।’’
অন্য দিকে অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্রর মতে, সমাজমাধ্যমে মমতা শঙ্করের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘‘মমতা শঙ্করকে ট্রোল করার আগে উনি ঠিক কী বলতে চেয়েছেন সেটা বোঝা উচিত।’’ একই সঙ্গে শ্রীলেখা লিখেছেন, ‘‘আমি নিশ্চিত উনি লাইসেন্সড যৌনকর্মীদের অসম্মান করতে চাননি।’’ এই প্রসঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনকে শ্রীলেখা স্পষ্ট বললেন, ‘‘বুঝতে হবে উনি কোন প্রজন্মের মানুষ। তাঁকে হঠাৎ করেই কেউ যা খুশি বলতে পারেন না। উনি তো সকল মহিলার উদ্দেশে কিছু বলেননি।’’
নতুন প্রজন্ম পোশাককে নিজের ‘স্বার্থে’ ব্যবহার করে, মনে করেন শ্রীলেখা। তাঁর কথায়, ‘‘আলিয়া ভট্ট বা করিনা কপূরের মতো শাড়ি পরলে কাউকে না মানাতেও পারে। নারী ক্ষমতায়ন মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়।’’ অভিনেত্রীর প্রশ্ন, ‘‘ভিউ পাওয়ার জন্য আজকে যাঁরা শাড়ির আঁচল নামিয়ে নিজের ভ্লগে রান্না শেখাচ্ছেন, তাঁরা যেমন দোষী, একই ভাবে যাঁরা দেখছেন তাঁরাও সমান দোষী।’’
সমাজমাধ্যমে মমতা শঙ্করের বক্তব্যের প্রতিবাদে ঘুরছে একটি সাদাকালো ছবি। যেখানে ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক জন মহিলা। তাঁর শাড়ির আঁচল কাঁধ থেকে সামান্য সরেছে। মুখে হাসি ও তাঁর এক হাতে সিগারেট। ছবিটি শেয়ার করে স্বস্তিকা লেখেন, ‘‘দারুণ হয়েছে। আমিও এ রকম একটা ছবি তুলব, ল্যাম্পপোস্ট- এর নিচে দাঁড়ানো খারাপ মেয়েগুলোকে উৎসর্গ করে। শাড়ির আঁচলেই কিনা সব সম্মান লুকিয়ে আছে, যদি ওরা জানত। আমার বন্ধু ফোটোগ্রাফাররা একটু হাত খালি হলে জানিয়ো।’’
মমতা শঙ্করের বক্তব্য প্রসঙ্গে অভিনেত্রী রূপাঞ্জনা মিত্র ফেসবুকে লেখেন, ‘‘ল্যাম্পপোস্ট বা খুঁটিগুলো এই শহর থেকে অনেক আগে তুলে দেওয়া উচিত ছিল বলে আমার মনে হয়। কারণ আবার প্রমাণিত হল যে ‘মেয়েরাই মেয়েদের চরম শত্রু।’’’ আবার অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী কারও নাম না উল্লেখ করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘হেডলাইন দেখে ‘পুরোটা বুঝে গেছি’ ভাবাটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে আমাদের। ধৈর্য জিনিসটা প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে! কী বলছি, কাকে বলছি, কার সম্পর্কে বলছি, কী ভাবে বলছি— সেই মাত্রাবোধও বিলুপ্ত প্রায়!’’ সুদীপ্তা কি মমতা শঙ্করের বক্তব্য প্রসঙ্গেই এই পোস্ট করেছেন? আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে প্রশ্ন করা হলে অভিনেত্রী এই প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিষয়টিকে কী ভাবে দেখছেন মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়? আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘ওঁর পশ্চাদপদী মন্তব্যের ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। আগেও তিনি সমকামিতা এবং রূপান্তকামিতার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ওঁকে সমর্থন করে সমাজের একাংশ যে ভুল বার্তা দিচ্ছে। সেটা আরও অস্বস্তিকর।’’ এই ধরনের সমর্থন মহিলাদের ‘বোকা’ প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা যেন। নারীকে নিয়ন্ত্রণ করে ‘বাজার’, সেই বার্তাই দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেই মনে করছেন রত্নাবলী। তাঁর মতে, ‘ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা’ বলে যৌনকর্মীদের পেশার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছেন মমতা শঙ্কর। রত্নাবলীর কথায়, ‘‘তিনি যে মহিলাদের কথা বলেছেন, তাঁদের মর্যাদা ও শ্রমের মূল্যকে লঘু করেছেন।’’ সম্পূর্ণ বিষয়টির মধ্যে গোপন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুললেন রত্নাবলী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy