মুক্তি পাচ্ছে ধ্রুব মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ছবি ‘বগলা মামা যুগ যুগ জিও’। ছবি: সংগৃহীত।
টলিপাড়ায় পূর্ণ করেছেন পাঁচ বছর। ভিন্ন পথে হেঁটে তৈরি করেছেন নিজস্ব ছবির জগৎ। বিশ্বাস করেন না ইন্ডাস্ট্রির প্রতিযোগিতায়। আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছে দিতে চান বাংলা ছবিকে। ‘বগলা মামা যুগ যুগ জিও’ ছবিটির মুক্তির আগে আনন্দবাজার অনলাইনের প্রশ্নের মুখোমুখি ছবির পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: আপনি ক্রিকেট পছন্দ করেন?
ধ্রুব: প্রচণ্ড। খেলতে আরও বেশি পছন্দ করি।
প্রশ্ন: বিশ্বকাপ ছেড়ে আপনি ছবির সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত!
ধ্রুব: (হাসতে হাসতে) ক্রিকেট-ফুটবল ভালবাসি। কিন্তু, সিনেমার থেকে বেশি নয়। আসলে অল্প কাজ করি তো, তাই প্রতিটা অংশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকি। ভালটাও যেমন থেকে যাবে, ভুলটাও কিন্তু ছবির মধ্যে থেকে যায়। তাই শেষ পর্যন্ত চেষ্টাটুকু করে যেতে চাই।
প্রশ্ন: সচেতন ভাবেই কি তাই কম কাজ করেন?
ধ্রুব: বেশি ছবি পরিচালনার কোনও বাসনা আমার নেই। বরং যে ক’টা ছবি তৈরি করব, সেগুলো যেন দর্শকের মনে গেঁথে যায় সেটাই চাইব। আজকে কে কী বলছেন, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ৩০ বছর পর আমার এই ছবিটা দর্শক দেখতে চাইবেন তো? প্রচুর কাজ করলে হয়তো তার সপক্ষে আমি কিছু বলতে পারব না।
প্রশ্ন: বাংলার হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি এবং ইতিহাস আপনার ছবিতে ফিরে ফিরে আসে। কোনও বিশেষ কারণ?
ধ্রুব: কর্মসূত্রে ২০ বছর কলকাতার বাইরে ছিলাম। কিন্তু আমি আমার শিকড়কে ভুলিনি। প্রতিটা মুহূর্তে বাংলাকে মিস্ করেছি। ফিরে এসে নতুন করে নিজের জায়গাকেই নতুন করে খোঁজার চেষ্টা করছি। সেই ভাল লাগাটাই ছবির মাধ্যমে দর্শকের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছি।
প্রশ্ন: পারিবারিক দর্শকের কথা মাথায় রেখেই কি আপনি ছবি ভাবেন?
ধ্রুব: ১০০ শতাংশ। কারণ, এক জন পরিচালক হিসাবে ওটিটি এবং বড় পর্দার পার্থক্যটা বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। সারা বিশ্বে বড় পর্দার জন্য যে ছবিগুলো তৈরি হচ্ছে, সেখানে ‘ফ্যান্টাসি’ একটা বড় জায়গা দখল করে রয়েছে। তার থেকেও বড় কথা, আমার মনে হয়, সিনেমা টিকে থাকে পারিবারিক প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে।
প্রশ্ন: কিন্তু এর বাইরেও তো ছবি তৈরি হয়...।
ধ্রুব: মানুষের জীবনে এখন সমস্যার শেষ নেই। ঈশ্বর আমাকে সেখানে আড়াই ঘণ্টা তাঁদের আনন্দ দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি না, সমকালীন ভয়াবহতা ছবিতে তুলে না ধরলে তিনি পরিচালক হিসাবে ব্যর্থ। ইন্ডাস্ট্রিতে একটা সমতা বজায় রাখতে হবে তো। বিষাদ বা দুঃখ তুলে ধরার জন্য আরও নির্মাতা রয়েছেন তো। সিনেমা আমার কাছে দর্শকের পরীক্ষা নেওয়া নয়। সিনেমা নিজের পাণ্ডিত্য ফলানোরও জায়গা নয়। আমার ছবি দেখলে দর্শকের যেন মনে হয়, সামনে দক্ষিণের জানলা খুলে গেল— এর বেশি কিছু চাই না।
প্রশ্ন: এই ভাবনা থেকেই এ বার কমেডি ছবিতে হাত দিলেন?
ধ্রুব: আমি যখন স্কুলের ছাত্র, তখন থেকেই বগলা মামাকে নিয়ে ছবি করার স্বপ্ন দেখতাম (হাসি)।
প্রশ্ন: কিন্তু ছবিতে তথাকথিত ‘স্টার’ নেই। তার উপর বগলা মামা ততটা পরিচিত চরিত্র নন। ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে না?
ধ্রুব: আমি বাংলা সিনেমার কমেডি ঘরানার ভক্ত। আগে বাংলায় যে সুপারহিট কমেডি ছবিগুলো তৈরি হয়েছিল, সেখানে কি ‘স্টার’ ছিল? সেখানে ছিলেন অভিনেতা। বাংলা ছবিতে কমেডি কোনও দিনই তারকা-নির্ভর ছিল না। গল্প, চিত্রনাট্য এবং অভিনয়ে ভর করে তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন: মূল গল্পকে ছবিতে কতটা পরিবর্তন করা হয়েছে?
ধ্রুব: সাহিত্যকে বড় পর্দায় তুলে ধরতে হলে কিছু পরিবর্তন করতেই হয়। তার উপর আমাদের কাহিনির প্রেক্ষাপট আশির দশক। মূল গল্পে বগলার বন্ধুর সংখ্যা ন’জন। আমি সেটা পাঁচ জন করেছি। আমি শুধু গল্পের প্রেক্ষাপটটুকু নিয়েছি। বাকি ৮৫ শতাংশ আমার নিজের তৈরি। অনেক নতুন চরিত্র রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৮টা প্রধান চরিত্র। কিন্তু হলফ করে বলছি, ছবিটা দেখার পর কেউ বলতে পারবে না যে কোনও চরিত্রকে বেমানান মনে হয়েছে।
প্রশ্ন: অনেকে বলছেন, বগলা মামার সিক্যুয়েল তৈরি হবে?
ধ্রুব: টলিউডে সাধারণত কোনও ছবি হিট করলে তার পর সিক্যুয়েলের ভাবনা শুরু হয়। এর মধ্যে দোষের কোনও কারণ নেই। তবে, বগলা মামা কিন্তু একটা ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি হিসাবেই ভেবেছিলাম। সোনাদা নিয়ে যে দিন প্রথম প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, সে দিনই বলেছিলাম, কমপক্ষে তিনটে ছবি তৈরি করব।
প্রশ্ন: সব ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি আবার সফলও হয় না।
ধ্রুব: বাংলায় ফ্র্যাঞ্চাইজ়িকে খুব ছোট নজরে দেখা হয়। কারণ এর মানেটাই অনেকে বোঝেন না। আর সফল ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি তৈরি করতে হলে যে পরিশ্রম করতে হয়, তার ৫ শতাংশও এখানে কেউ করতে রাজি নন।
প্রশ্ন: হঠাৎ কেন বলছেন?
ধ্রুব: ফেলুদা, ব্যোমকেশ এবং কাকাবাবুর পর আর কোনও নতুন চরিত্র কি দর্শকদের নজর কেড়েছে? শবর আছে, কিন্তু ততটা জোরালো নয়। সোনাদা কিন্তু একটা নতুন চরিত্র হয়ে দর্শকদের কাছে নিজের জায়গাটা তৈরি করতে পেরেছে। পাশাপাশি বক্স অফিসেও ব্যবসা বেড়েছে। কারণ শুরু থেকেই সোনাদাকে ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল।
প্রশ্ন: মাত্র পাঁচ বছরে দুটো ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি তৈরি করলেন। একটা সফল, অন্যটার মুক্তি আসন্ন। গর্ব হয়?
ধ্রুব: বরং উল্টোটা। দর্শক যে আমাকে সুযোগ দিয়েছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। মুম্বইয়ে কাজ করতে গিয়েই এটা শিখেছি। ‘লিট্ল কৃষ্ণ’ এবং ‘শক্তিমান’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি, মার্ভেল এবং পিক্সার-এর মতো বিশ্বখ্যাত স্টুডিয়োর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে শিখেছি। পাশাপাশি এটাও না বললেই নয়, পরিচালক রাজকুমার হিরানিকে দেখেছি, কী ভাবে তিনি ধীরে ধীরে মুন্নাভাই চরিত্রটিকে তৈরি করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাই হয়তো আজকে কাজে লাগাতে পারছি।
প্রশ্ন: চিত্রনাট্যকার শুভেন্দু দাশমুন্সীর সঙ্গে সোনাদা তৈরি করেছিলেন। আপনাদের মধ্যে নাকি দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে খবর।
ধ্রুব: বিষয়টাকে খুব সহজ ভাবে দেখা উচিত। আমি বাংলায় ছবি করতে এসে বুঝেছিলাম, এখানে ভাল চিত্রনাট্যকারের অভাব রয়েছে। আমার প্রতিটি ছবিতেই এক জন সহ-চিত্রনাট্যকার ছিলেন। নতুনদের সুযোগ দিতে আমার কোনও আপত্তি নেই। শুভেন্দুর প্রথম চিত্রনাট্যই আমার সঙ্গে। আজকে ও একাধিক ছবির চিত্রনাট্য লিখছে। আমি খুব খুশি। ভবিষ্যতে সুযোগ হলে আবার হয়তো আমরা একসঙ্গে কাজ করব।
প্রশ্ন: এখন টলিপাড়ায় অল্প দিনে ছবির শুটিং শেষ করা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। আপনি যে ধরনের ছবি করেন, সেখানে এই নীতি সমর্থন করেন?
ধ্রুব: ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ ১৭ দিনে শেষ করেছিলাম। দ্বিতীয় ছবি ২৩ দিনে। ‘গোলন্দাজ’ ৩৬ দিনে শেষ করেছিলাম। বগলা শেষ করেছি ২৪ দিনে। নিজের ছবির জন্য পরিচালক কী কী পাবেন, সেটা নির্ভর করে প্রযোজকের কাছে তাঁর প্রস্তাবের উপর। এই মুহূর্তে টলিউডে যে ধরনের ছবি তৈরি হচ্ছে, সেখানে শুটিংয়ের জন্য ২০ থেকে ২৫ দিন পাওয়া মানে একটা সম্মানজনক জায়গা। কিন্তু তার আগে প্রযোজকের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। শুধুই সমালোচনা করে লাভ নেই।
প্রশ্ন: আপনার প্রথম ছবি ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ তৈরির পথ নিশ্চয়ই এতটা সহজ ছিল না।
ধ্রুব: সবাই বলেছিল, বড় চাকরি ছেড়ে ছবি পরিচালনার সিদ্ধান্ত নাকি আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল সিদ্ধান্ত! বলা হয়েছিল, বাংলা ছবি নাকি এখন ১ কোটি টাকারও ব্যবসা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সেখানে বিগত পাঁচ বছরে আমি বক্স অফিসে ১০ কোটি টাকার ব্যবসা দিয়েছি। নিজের ছবি এবং দর্শকের উপর বিশ্বাস না রাখলে এটা সম্ভব হত না।
প্রশ্ন: মুম্বই থেকে আপনার কাছে কোনও প্রস্তাব আসেনি?
ধ্রুব: বহু। কিন্তু এই মুহূর্তে বলিউড থেকে বাংলার পরিচালকদের কাছে শুধু পরিচালনার প্রস্তাব আসে। কারণ, ওরা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি চাইছে। বিষয়বস্তু এবং চিত্রনাট্য কিন্তু মুম্বইয়ের তৈরি। আমি এই ভাবে পরিচালনা করতে চাই না।
প্রশ্ন: আর টলিউড?
ধ্রুব: বাংলায় এমন কোনও প্রযোজক বাকি নেই, যাঁর থেকে প্রস্তাব আসেনি। প্রযোজক পেতে চার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তখন যাঁরা মুখ ফিরিয়েছিলেন, তাঁরাই তো আজকে প্রস্তাব দেন। সেই পরিস্থিতিতে যিনি আমাকে সুযোগ দিয়েছিলেন, তাঁকে বাদ দিয়ে বাইরে কাজ করতে চাই না। সম্পর্কে থাকাকালীন পাশ দিয়ে কোনও সুন্দরীকে দেখে তার হাত ধরে নেওয়া মানে তো সম্পর্কটাই অর্থহীন।
প্রশ্ন: সোনাদার পরবর্তী অভিযানের কী খবর?
ধ্রুব: আমি সোনাদার সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেছি (হাসি)। সোনাদা, আবীর আর ঝিনুক— তিন জনেই একটু ছুটির মেজাজে রয়েছে। ওরা রাজি হলেই ঠিক জানতে পারবেন।
প্রশ্ন: আপনি কি ‘মাস’ ছবি তৈরি করবেন কখনও?
ধ্রুব: ‘রঘু ডাকাত’-এর থেকে বড় মাস ছবি আর কী হতে পারে! সেই জন্যই তো ছবিটার প্রস্তুতিতে এতটা সময় নিচ্ছি। পাঁচ-সাত বছর অন্তর মনে হয় প্রতিটি পরিচালকেরই ছবির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো উচিত। তখন হয়তো আপনি যে ধরনের ‘বাণিজ্যিক’ ছবি বলছেন, সেটা করতে পারি।
প্রশ্ন: দু’বছর আগে দেবকে নিয়ে ছবিটার ঘোষণা হয়েছিল। এতটা দেরি কেন হচ্ছে?
ধ্রুব: দেরি শব্দটা এখানে ভুল! ছবির প্রস্তুতি চলছে। ইচ্ছে করেই করছি না। এ রকম অসম্ভব একটি ছবিকে প্রযোজক হ্যাঁ বলেছেন। তাঁর সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করি। ফলে আমার দায়িত্বও বেড়েছে। তাই কোনও খুঁত রাখতে চাই না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy