প্রশ্ন: ‘বাবু সোনা’ ছবিটায় অভিনয় করতে রাজি হলেন কেন?
পায়েল: অনেক দিন পর একটা ‘মশালা’ ছবি তৈরি হয়েছে। ছবিতে বিনোদনের মাত্রাও বেশি। এ রকম কমেডি তো বড় একটা তৈরি হয় না।
প্রশ্ন: গত কয়েক বছরে মূল ধারার কমেডি ছবি তৈরি একদম কমে গিয়েছে।
পায়েল: আমি জানি। সাম্প্রতিক অতীতে কমেডি ছবি সফল হয়নি, সেটা জানি। ছবি তৈরি হলে আমরা দর্শকের কাছে ছবিটাকে পৌঁছে দিতে পারি মাত্র। আসলে বাণিজ্যিক ছবি তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় ২০ বছর কাটিয়ে ফেললেন। একটা সময় ছিল, যখন বাংলা ছবির নায়িকারা পর পর ছবিতে কাজ করতেন। এখন সেটা কেন হচ্ছে না?
পায়েল: ২০০৭ সালে ‘আই লভ ইউ’ ছবিতে প্রথম মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করি। তার পর থেকে আমি কিন্তু কাজ করে চলেছি। শিল্পীর কেরিয়ারে চড়াই-উতরাই থাকতেই পারে। আমি কিন্তু কখনও বিরতি নিইনি।
প্রশ্ন: অভিনেতাদের ভিড়ে ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনেত্রীদের চ্যালেঞ্জ নাকি অনেক বেশি। সেখানে কখনও ‘কাস্টিং কাউচ’-এর সম্মুখীন হতে হয়েছে?
পায়েল: ইন্ডাস্ট্রির সব ঘটনা কিন্তু আমার নিয়ন্ত্রণে নেই, এটা আগে মেনে নিতে হবে। অভিনেত্রী হিসেবে আমি কী দিতে পারছি, সেটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাই। অল্প বয়সে অভিনয় করতে শুরু করি। তাই পরিচালক বা প্রযোজকেরা যেন আমার কাজ দেখেই আমাকে নির্বাচন করেন, সেটাই চেয়েছি। আর ঈশ্বরের আশীর্বাদে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। কাজের জন্য কখনও মাথা নিচু করিনি।
প্রশ্ন: কিন্তু ‘কাস্টিং কাউচ’?
পায়েল: হয়েছে। কিন্তু সেটাকে আমি তখনই নিয়ন্ত্রণ করে নিয়েছি। হতে পারে যে, তিনি ভবিষ্যতে আমাকে নতুন কাজের প্রস্তাব দেননি। তাতে আমার কোনও সমস্যা হয়নি।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রির বড় প্রয়োজনা সংস্থা বহু অভিনেত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করে। আপনার কী মত?
পায়েল: কোনও একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে বাঁধা থেকে যদি কাজ করতে হত, তা হলে তো আমি ব্যাঙ্কে কাজ করতে পারতাম!
প্রশ্ন: কিন্তু ‘বড়’ ছবির অংশ হতে পারতেন।
পায়েল: ছবি বড় বা ছোট হয় না। ছবিকে সফল করেন দর্শক। কাজের মাধ্যমেই আমার আজকের পরিচিতি। তাই সেখানে আমার কোনও অনুশোচনা নেই।
প্রশ্ন: ভাল চরিত্র তো হাতছাড়াও হতে পারে...
পায়েল: সে তো হতেই পারে। অনেক ছবি দেখেই মনে হয়, যদি আমি করতে পারতাম। অনেক হিন্দি ছবি দেখেও সেটা আমার মনে হয়।

আরও পড়ুন:
প্রশ্ন: সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার কাজ চর্চিত। কিন্তু তার পর আর একসঙ্গে ছবি করলেন না। কখনও কথা হয়েছে?
পায়েল: ইন্ডাস্ট্রিতে আমার বন্ধুর সংখ্যা খুবই কম। ব্যক্তিগত জীবন এবং পেশাকে আলাদা রাখতেই পছন্দ করি। আবার মৈনাক ভৌমিক, রাজা চন্দের মতো কিছু ভাল বন্ধুও রয়েছেন। সম্প্রতি মৈনাকের ছবিতে তো অভিনয়ও করলাম।
প্রশ্ন: মুম্বইয়ে এখন টলিপাড়ার অনেকেই নিয়মিত কাজ করছেন। আপনার ইচ্ছে করে না?
পায়েল: কিছু কিছু প্রস্তাব এসেছে। আলোচনা চলছে। দেখা যাক, কী হয়। কারণ মুম্বইয়ে এখন কাজ করলে, সেই কাজই করব, যাতে দর্শকের চোখে পড়ে। মুম্বইয়ে অভিনয় করলাম, এ দিকে কেউ জানতেই পারল না, সে রকম কাজ করতে চাই না।
প্রশ্ন: বাংলা ইন্ডাস্ট্রির স্ট্রাগল এবং ইঁদুরদৌড় নিয়ে আপনার কী মত?
পায়েল: তুলনা করতে গেলে হারিয়ে যাব। নিজের উপর থেকে ফোকাস হারিয়ে যাবে। নিজেকে অগ্রাধিকার না দিলে কিন্তু অভিনয় করা যায় না। আমি কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছি, সেটা আমি এবং আমার দর্শক ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না। বাংলা ছবি তো অনেকগুলো পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। অভিনেতা হিসেবে আমাদেরও তার মধ্যে দিয়ে এগোতে হবে।
প্রশ্ন: অতীতের সঙ্গে এখনকার বাংলা ছবির পার্থক্যের কথা বলতে চাইছেন কি?
পায়েল: একটা উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টা স্পষ্ট হবে। উত্তমকুমারের সময়ে বাংলা ছবিতে নায়িকার চরিত্রও কিন্তু নায়কের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ হত। উত্তমকুমারের বিপরীতে সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী বা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রগুলো দেখলেই সেটা স্পষ্ট হবে। কিন্তু তার পর একটা সময়ে বাংলা ছবি বড্ড বেশি নায়ক-কেন্দ্রিক হয়ে গেল। এখন আবার নারীকেন্দ্রিক ছবির সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর আমার ‘আবার অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিটা তো প্রেক্ষাগৃহে একশো দিন সম্পূর্ণ করেছিল। কিন্তু এখানে আমার একটা অন্য অভিযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন: কী রকম?
পায়েল: সেই সময় আমি আমেরিকায় একটা পুরস্কার নিতে গিয়ে সমাজমাধ্যমে কিছু ছবি পোস্ট করেছিলাম। কিন্তু সেই ছবি দেখার পর অনেকেই বলা শুরু করল, আমি নাকি পাত্র খুঁজতে আমেরিকায় গিয়েছি! অথচ ছবিটা নিয়ে কেউ কথা বলল না। তাই মনে হয়, অভিনেত্রীদের কাজের তুলনায় ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই মানুষের আগ্রহ বেশি। সে দিক থেকে দেখলে, বাঙালির আধুনিক, উন্মুক্ত চিন্তাধারাটা কোথাও যেন হারিয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়।
প্রশ্ন: কখনও মনে হয় যে, জীবন আগে অনেক সহজ ছিল?
পায়েল: যে যখন যেখানে দাঁড়িযে থাকে, তখন তার কাছে সেটা চ্যালেঞ্জিং মনে হতে পারে। তাই এই তুলনায় গিয়ে লাভ নেই।
প্রশ্ন: সমাজমাধ্যমে ট্রোলিং কী ভাবে সামলান?
পায়েল: আমি কোনও মন্তব্যই পড়ি না। আর পড়লেও বেশ মজা লাগে। সমাজমাধ্যমে ভাল বা খারাপ— কোনও মন্তব্য কাউকে মান্যতা দিতে পারে না বলেই বিশ্বাস করি।
প্রশ্ন: কিন্তু এই যে এখন বলে দেওয়া হয়, রিল তৈরি...
পায়েল: (থামিয়ে দিয়ে) করতেই হবে এমন কোনও নিয়ম নেই। আমার ভাল লাগলে আমি রিল পোস্ট করি।
প্রশ্ন: আপনি কি আগের তুলনায় অনেকটাই শান্ত হয়ে গিয়েছেন?
পায়েল: (হেসে) সত্যিই তাই। এখন আর কোনও কিছুই আমাকে খুব বেশি বিচলিত করে না। আর করলেও খুব দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারি।
প্রশ্ন: আপনি তো এখন একা। এই একা থাকাটা কতটা কঠিন?
পায়েল: (দেখুন) আমি এখনও আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকি। নিজের অনেক কাজ থাকে। নিজের সঙ্গে সময় কাটাতেও ভালবাসি। ভাল আছি। তাই একা থাকাটা আমার কাছে কোনও চ্যালেঞ্জ নয়।
প্রশ্ন: কিন্তু সম্পর্ক বা বিয়ে, আগামীর কোনও পরিকল্পনা মনের মধ্যে ভিড় করে না?
পায়েল: কমলদা (পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়) একবার আমাকে বলেছিলেন যে, কেরিয়ার তৈরি করতে হলে তাড়াতাড়ি বিয়ে করা যাবে না। আবার জীবনে এ রকম কেউও থাকতে পারেন যে, তিনি হয়তো আমাকে আমার সম্পূর্ণ কেরিয়ারে সাপোর্ট করে গেলেন। একজন প্রকৃত পুরুষ কিন্তু কখনওই তাঁর জীবনসঙ্গীকে পিছিয়ে রাখতে চাইবেন না। বরং সাপোর্ট করবেন, সঙ্গীকে সব সময় এগিয়ে দেবেন। এ রকম মানুষ কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: আপনি এ রকম কাউকে খুঁজে পেয়েছেন?
পায়েল: (হেসে) দেখা যাক। ঠিক সময়ে জানতে পারবেন।
প্রশ্ন: রাজ-শুভশ্রী অভিনয়, পরিচালনা, সংসার— সবটাই দু’জনে সমান দায়িত্ব ভাগ করে করছেন। ইন্ডাস্ট্রিতে ওঁদের যে ‘পারফেক্ট কাপল’ বলা হয়। তা নিয়ে আপনার কী মত?
পায়েল: শুভশ্রীর সঙ্গে মাঝেমধ্যেই আমার দেখা হয়। কোনও সম্পর্কে কে কী ভাবে কতটা মানিয়ে নেবে বা দায়িত্ব ভাগ করে নেবে, সেটা ব্যক্তির উপরেই নির্ভর করে। সেখানে বাইরের কারও মন্তব্য না করাই ভাল।
প্রশ্ন: আপনি কি কখনও গুছিয়ে সংসার করতে পারবেন বলে মনে হয়?
পায়েল: ওই যে বললাম, আমি সে রকমই কোনও মানুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে চাইব, যিনি আমাকে অগ্রাধিকার দেবেন।

প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে এখন প্রায়শই ফেডারেশন বনাম শিল্পীদের মতানৈক্য প্রকাশ্যে আসছে। কোনও ভয়ের পরিবেশে কি কাজ করা সম্ভব?
পায়েল: ভয় একটাই। বার বার কাজে বাধা এলে হয়তো দর্শকের আগ্রহ হারিয়ে যেতে পারে। দর্শক জানেন, কোনও ভাল পরিচালক একটা ছবি তৈরি করছেন। তাঁদের প্রত্যাশা তৈরি হতে থাকে। তার পর যদি জানা যায় যে, কোনও কারণে সেটা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে বা ছবিটাই হচ্ছে না, সেটা তো খুবই খারাপ। নিজেদের মধ্যে এই সমস্যাগুলো মিটিয়ে নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন: প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে সরে এলেন কেন?
পায়েল: তখন তো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ পাইনি। আর রাজনীতির ময়দানে নেমে মানুষের জন্য কাজ করতে হলে, যে দলের হয়ে কাজ করছি, তাদের একটা সমর্থন থাকা উচিত। এই সমর্থনটা আমি তখন সেই ভাবে পাইনি। তা ছাড়া রাজনীতি একটা আলাদা পেশার মতো। আর অভিনয় ছেড়ে রাজনীতি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: এখন ইন্ডাস্ট্রি তথা সিনেমায় যে রাজনীতি প্রবেশ করেছে, সেটা কি খুব হতাশাজনক?
পায়েল: রাজনীতির প্রবেশ নিয়ে আমার কোনও আপত্তি নেই। যে পরিবর্তনই হোক না কেন, সেটা যেন ভাল হয়। সেটা যেন কাজের ক্ষেত্রে কোনও বাধা না সৃষ্টি করে।
প্রশ্ন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক এখন কী রকম?
পায়েল: দিদির সঙ্গে আমার আগেও ভাল সম্পর্ক ছিল, এখনও ভাল সম্পর্ক রয়েছে। ওই যে বলছিলাম, মহিলাদের প্রচুর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। একবার ভাবুন তো, দিদিকে কত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তাই একজন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আমি দিদিকে খুবই শ্রদ্ধা করি এবং ভালবাসি।