প্রার্থী: (বাঁ দিক থেকে) রত্না চট্টোপাধ্যায়, পায়েল সরকার এবং সমিতা হর চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র।
বেহালা পূর্ব কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে রত্না চট্টোপাধ্যায়ের নাম ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরে অনেকেই মনে করেছিলেন, নন্দীগ্রামের পরেই ভোট-চুম্বকের টান থাকবে এই কেন্দ্রে। বিদায়ী তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী, শোভন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ওই কেন্দ্রের বিধায়ক। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য তিনি এই কেন্দ্রে জেতেন। কিন্তু তার পরেই ঘটনার ঘনঘটা।
গত তিন বছরে শোভন এক বারের জন্যও কেন্দ্রে আসেননি বলে খবর। তৃণমূল ছেড়ে তিনি সবান্ধবী বিজেপিতে চলে গিয়েছিলেন। বেহালা পূর্ব থেকে তিনি বিজেপি প্রার্থী হবেন বলে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন। শোভন নিজেও তা-ই চেয়েছিলেন। তবে বাদ সাধেন বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁরা চেয়েছিলেন, শোভন লড়াইটা করুন বেহালা পশ্চিম থেকে। রাজি হননি শোভন। বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়েই বিজেপির সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। এর ফলে বঙ্গ রাজনীতিতে বোধহয় এই প্রথম স্বামী-স্ত্রীর নির্বাচনী লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েও মিলিয়ে গেল।
তবে এই কেন্দ্রের লড়াইকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন রত্না। এক দিকে তাঁকে লড়তে হচ্ছে শোভনের ছায়ার সঙ্গে। আবার শোভনকে তিন বছর ধরে কেন দেখা যায়নি, তার জবাবদিহিও করতে হচ্ছে। গনগনে গরমের দুপুরে রায়বাহাদুর রোডে বিদায়ী কাউন্সিলর, রত্নার নির্বাচনী এজেন্ট সুশান্ত ঘোষের দফতরে বসে রত্না বললেন, ‘‘শোভনের দেখা কেন পাওয়া যায়নি? এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলছি, তিন বছর ভুলে গিয়ে সামনের দিকে তাকান। আমি আপনাদের সঙ্গে আছি, থাকব।’’
কেন্দ্রে শোভন-পত্নী হিসেবেই রত্নার বেশি পরিচিতি। কিন্তু রত্না চান, বৌদি নয়, দিদি হিসেবেই মানুষ তাঁকে চিনুক। বললেন, ‘‘আমি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে। আমার মা-বাবা সক্রিয় রাজনীতির মানুষ। তাই আমাকে নতুন করে কিছু শিখতে হচ্ছে না।’’ ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও ছিলেন শোভন। সেখান থেকেই তাঁর কলকাতার মেয়র হওয়া। শোভনের অনুপস্থিতিতে ওই ওয়ার্ডকে মায়ের মতো যত্ন করেছেন বলে দাবি রত্নার। তাঁর হয়ে নির্বাচনী প্রচারে কখনও দেখা যাচ্ছে ছেলে ঋষিকে। আবার কখনও থাকছেন মেয়ে রুহিও। আমপানের সময়ে সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে এলাকাকে স্বাভাবিক করতে পেরেছিলেন, এ দাবিও
তিনি করলেন।
বিজেপি প্রার্থী, অভিনেত্রী পায়েল সরকার এলাকায় ‘বহিরাগত প্রার্থী’ বলে ক্ষোভ রয়েছে। ঘরের ছেলে শোভন যদি প্রার্থী হতেন তা হলে তৃণমূলকে উপযুক্ত জবাব দেওয়া যেত— এই ভাবনা এলাকার অনেক বিজেপি সমর্থক-কর্মীরই। পায়েলের অবশ্য জবাব, ‘‘মাদার টেরিজা, ভগিনী নিবেদিতা বহিরাগত? এমন ভাবতে শুরু করলে কিন্তু পাশের ঘরে থাকা মানুষটাকেও কোনও দিন বহিরাগত ভাবতে হবে।’’ বিজেপিতে যোগ দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টিকিট পেয়েছেন পায়েল। তাঁকে নিয়ে রত্নার বক্তব্য, ‘‘প্রার্থী নয়, কোন দলের বিরুদ্ধে লড়ছি সেটাই বড়। বিজেপি যদি এখানে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ বা শোভনকে প্রার্থী করত, তা হলেও লড়াইটা একই থাকত।’’
জেমস লং সরণির ক্ষণিকা ভিলাতেই এখন বিজেপির এই কেন্দ্রের নির্বাচনী কাজ চলছে। সেখানে বসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্রী পায়েলের দাবি, সক্রিয় রাজনীতি না করলেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই সচেতনতা গড়ে উঠেছিল। তাই একেবারে আনাড়ি তাঁকে বলা যায় না। প্রায় রত্নার সুরেই বললেন, ‘‘লড়াইয়ের ময়দানে নামলে বিরুদ্ধে কেউ তো থাকবেনই। তবে প্রার্থী নয়, কোন দলের বিরুদ্ধে লড়ছি সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’’
এর পরেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন বিকেলের প্রচারে। হুড খোলা জিপে বেহালার অলিগলি ঘুরে সদলবলে প্রচার। জেমস লং সরণি থেকে গলিতে ঢুকল পায়েলের জিপ। ‘জয় শ্রীরাম’ আওয়াজে আশপাশের বাড়ি থেকে উঁকি দিচ্ছে উৎসুক মুখেরা। এক বাড়ির বারান্দা থেকে এক মহিলা অন্য বাড়ির বৃদ্ধকে বলে উঠলেন, ‘‘বলেছিলাম না, বিজেপি-ঝড় উঠেছে।’’
রত্না অবশ্য বিষয়টিকে গুরুত্বই দিতে চান না। তার কারণও আছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে যখন বহু কেন্দ্রেই বিজেপি ভোটের হিসেবে এগিয়ে গিয়েছিল, এই বেহালা পূর্বে তৃণমূলই এগিয়ে থেকেছে। তবে বিজেপির ব্যাপক প্রচার। ঘনঘন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আগমন। পাশাপাশি সিন্ডিকেট রাজের প্রবল কাঁটা বিঁধে রয়েছে রত্নার গলায়। তাঁর মতে, আসল কারণ বেকারত্ব। চাকরি থাকলে সিন্ডিকেট চক্রে কেউ যায় না। জিতে গেলে অবশ্যই এই নিয়ে ভাবতে হবে। তাঁর কথায়, ‘‘দিদি আমার উপরে ভরসা করে এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছেন। তাই তৃণমূল যেন এই আসন পায়, তার জন্য যা করার করে চলেছি।’’
ছাত্র রাজনীতি করে উঠে আসা সমিতা হর চৌধুরীকে সিপিএম সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী করেছে। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কলকাতা জেলা সভানেত্রী সমিতা বেহালার ভূমিকন্যা। বলছিলেন, ‘‘প্রচারে গিয়ে বুঝছি মানুষ খুবই বিরক্ত তৃণমূল সরকারের উপরে। কাটমানি, সিন্ডিকেট রাজ, বেকারত্ব— এ সব নিয়ে তাঁরা বিপর্যস্ত। প্রচারে বলছি, আমরা ক্ষমতায় এলে কাটমানি আর সিন্ডিকেট রাজ— এই দুই শব্দ পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে যেন আর উচ্চারণ করতে না হয়, সেই চেষ্টা করা হবে।’’
দীর্ঘ দিন বিধায়কের অনুপস্থিতিতে মানুষের চরম দুর্ভোগ হয়েছে, তা-ও জানালেন তিনি। সমিতার কাছেও বিপক্ষের প্রার্থী বড় কথা নয়। বললেন, ‘‘কোন দল বিরোধীর ভূমিকায় রয়েছে সেটাই বড় কথা। তৃণমূল ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া। আর বিজেপি ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার জন্য মরিয়া। কিন্তু মানুষকে বুঝতে হবে, এই দুই দল একই মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠ। সেই বোঝানোর কাজই চালিয়ে যাচ্ছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy