প্রতীকী ছবি।
এ দেশের যে দিকে চাইবেন, সে দিকেই দেখবেন চাউন্তি মানুষ, হাজারেবিজারে, অগুনতি। শুধু দেনেওয়ালারই দেখা নেই।
যাদের দিউন্তি হওয়ার কথা, তারাও আসলে ছুপা চাউন্তি বৈ তো নয়। যার অঢেল আছে, সে-ও যদি চায়, তা হলে বল মা তারা, দাঁড়াই কোথা! এই দেওয়া আর পাওয়ার খেলার মধ্যেই মাকু মারছে এ দেশের পলিটিক্স, এ কথা কে না জানে!
বঙ্কিম আরও সরেস করে বলেছেন, পেয়াদারও শ্বশুরবাড়ি আছে, কিন্তু অষ্টাদশ অশ্বারোহীমাত্র যে দেশকে জয় করিয়াছিল, তাহার পলিটিক্স নাই। ‘জয় রাধে, ভিক্ষা দাও গো’, ইহাই আমাদের পলিটিক্স।
সে যাক গে, ইহজীবনে বিস্তর ভোটরঙ্গ পেরিয়ে এসেছি। তাই আবারও একটা ভোটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমজনতার মতো আমারও কোনও ধুকপুকুনি নেই। কোনও নতুন আশা-ভরসা, কোনও সুখস্বপ্ন, কোনও আলাদীনের অবাক পিদিমের আকাঙ্ক্ষা আমরা আম মানুষেরা বহুকাল আগেই বিসর্জন দিয়েছি। ভোটের মুখে নেতারা যা বলেন, তা যে খুড়োর কল, তা আমাদের ছানাপোনারাও জানে। ও সব রূপকথা শুনতে মন্দ নয়, এই যা। তাঁরা আমাদের অনেক কিছুই নাকি দিতে চান। ভোটে জিতলেই তোষাখানার দরজা আমাদের জন্য হাট করে খুলে দেবেন। শুধু মনে পড়ে, ভারতবর্ষ এক সোনায় মোড়া দেশ, এই কিংবদন্তীর টানে
পাঠান-মোগল আসার আগেই বিস্তর বোম্বেটে, লুটেরা এ দেশকে বার বার লুট করে গেছে। ভারতবর্ষের সন্ধানে বেরিয়ে দিগ্ভ্রষ্ট কলম্বাস আমেরিকা পর্যন্ত আবিষ্কার করে ফেললেন! তার পরে পাঠান-মোগল-ইংরেজের লাগাতার শোষণে ছিবড়ে হয়ে যাওয়া এই দেশ এখনও রক্তাল্পতায় সাড়শূন্য। আর যেটুকু বা আছে, তা-ও কি আর তোমার-আমার জন্য? বাবুভাইদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা আছে না? এখন আর বাইরে থেকে লুটেরা তেমন আসে না, এ দেশেই আমরা লুটেরা তৈরির কল বানিয়ে ফেলেছি। আমাদের পলিটিক্স তাই এখনও ‘জয় রাধে, ভিক্ষা দাও গো’। এর বেশি আর চাইতে সাহস হয় না। দাবিদাওয়া, সমান অধিকার, গণতন্ত্রের মহান পবিত্রতা, সংবিধানের অকাট্যতা— এ সব আমাদের নিরেট মাথায় বহুকাল ধরে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বটে, এবং আমরা যে বুঝিনি তা-ও নয়। তবে আবছামতো। কারণ, জিনিসগুলো কানে শোনা বটে, কিন্তু দেখা জিনিসের মধ্যে পড়ে না কি না!
এক ভদ্রলোক মেয়ের শংসাপত্রের জন্য এম এল এ-র কাছে গিয়ে গদগদ হয়ে বলে ফেলেছিলেন, স্যর, আমি কিন্তু আপনাকেই ভোট দিয়েছি। এম এল এ উদাস মুখে বললেন, তাতে কী হয়েছে, আমাকে তো আরও কত লোকেই ভোট দিয়েছে! শুনে ভদ্রলোক অপ্রস্তুত হলেন বটে, কিন্তু এটাই তো লাখ কথার এক কথা! কে মশাই আপনি, কোন হরিদাস! আপনার তো একটামাত্র ভোট, তাই দিয়ে কি মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি?
এ সব ভাবলে নিজেকে ভারী তুচ্ছাতিতুচ্ছ বলে মনে হয় না? আমার এবং আমার মতো আরও অনেকেরই কিন্তু হয়। সে আপনি গণতন্ত্রের মহামান্যতার কথা যতই বলুন। কোটি কোটি ভোটের মধ্যে একটা ভোট, মহারণ্যে অগুনতি খসে পড়া শুকনো পাতার মতোই একটা, বলতে গেলে যার কোনও আইডেন্টিটিই নেই। আর এই দেশে, যেখানে পিলপিল করছে একশো সাঁইত্রিশ কোটি লোক! লোক না পোক! তাদের হাতে ভোটার কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বোঝানো হয়েছে, ওহে জনগণ, তুমি এবং তোমরাই দেশের প্রকৃত শাসক।
দুঃখের বিষয়, জনগণ কথাটা বিশ্বাস করতে চাইছেও, কিন্তু বুকের পাটার অভাবে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। রাম, শ্যাম, যদু, টম, ডিক, হ্যারি, আবদুল, রহিম, গফুর— আমরা সবাই শাসক? আমরাই দেশের হর্তা-কর্তা-বিধাতা? ভাবতে বেশ লাগে কিন্তু! সত্যি বটে, আমরাই তো নেতাদের ‘ভাই সব’, আমরাই তো মাতব্বরদের ‘প্রিয় জনগণ’, আমরাই তো তাঁদের ‘বন্ধুগণ’ বা ‘কমরেড’। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমাদের এ সব ভাল কথাও মনে হয়। বিশেষ করে যখন ভোট আসে। জিনিসপত্রের দর যখন-তখন বাড়ে বটে, কিন্তু আমাদের, অর্থাৎ এই জনগণের দর বাড়ে ভোটের মরশুমে। নিজেকে ভারী কেষ্টবিষ্টু মনে হয় তখন। মনে হয়, একটা ভোটেরও তো বেশ দম আছে মশাই!
বাজারের নিয়ম হল, সাপ্লাই বাড়লে দাম কমে যায়। শুনেছি, অ্যালুমিনিয়াম যখন প্রথম আবিষ্কার হল, তখন নাকি একটা অ্যালুমিনিয়ামের চামচের দাম পড়েছিল পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা! এখন দেখুন, অ্যালুমিনিয়ামের চামচ গরিবেও ছোঁয় না। কপালের দোষে ভারতবর্ষে জনগণের সাপ্লাই এত বেড়ে গেল যে, দর পাওয়াই মুশকিল। সে চণ্ডীদাস ঠাকুর যতই বলুন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
তবু ভোটের এই তরজার আসরে মাতব্বরেরা তো আমাদেরই মনোরঞ্জন, মানভঞ্জন, ব্যথাখণ্ডন করতে নেমে পড়েছেন! পাশাপাশি, খেউরেরও অভাব নেই। পুরাকালে ভগীরথ গঙ্গা আনয়ন করেছিলেন, এ কালের নব্য ভগীরথেরা পূতিগন্ধময় নর্দমা নামিয়ে আনছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। নৌটঙ্কির আসর বা নোংরা কাজিয়ার ভাষাকেও লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে হরেক টিপ্পনী। এ সবও জনগণকে জাগিয়ে, চেতিয়ে, বেতিয়ে তোলার জন্যই বোধহয়। জাগ শালা জনগণ, দে ওদের গুঁতিয়ে!
এই শীর্ণকায় রাজ্যটি ভোটের মুখে এসে ভারী ফাঁপরে পড়েছে, কার গলায় যে মালা দেবে! মুজতবা আলীর একটা লেখায় নেশার ঘোরে বলা এক গেঁজেলের গল্পে ছিল, এক শিকারি জঙ্গলে গিয়ে একটা পাখিকে গুলি করে নিজের শিকারি কুকুরটাকেও লেলিয়ে দিয়েছিলেন। তার পরে গুলি আর কুকুরের সে কি রেস! কভি গোলি তো কভি কুত্তা, কভি কুত্তা তো কভি গোলি— বলতে বলতে গেঁজেলের সে কী উত্তেজনা!
জনগণও এখন যেন সেই রকমই এক উত্তেজক, অলীক রেস দেখছে। টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, খবরের কাগজে, সভা-সমিতিতে। কে হারে, কে জেতে, কে জানে বাবা। কিন্তু শেষ অবধি আমাদের কী আসে যায় বলো দিনি! আমাদের সম্বল তো সেই ‘জয় রাধে, ভিক্ষা দাও গো’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy