অটো চালালে প্রচুর ময়লা লাগে গায়ে। ধোঁয়া-ধুলো সামলাতে পারি। মানুষের ময়লা গায়ে লাগলে উঠতে চায় না। ছবি: শাটারস্টক।
আমি কলেজে ঢুকেছিলাম। পাশ করতে পারিনি। কত লোক বি এ পাস না করেও সেলিব্রিটি হয়ে গেল। সিনেমা করে সেলিব্রিটি হয়ে গেল। আশ্রম খুলে সেলিব্রিটি হয়ে গেল। খুন করে সেলিব্রিটি হয়ে গেল। কোকেন পাচার করে সেলিব্রিটি হয়ে গেল। আমি গড়িয়া টু এইট বি আর এইট বি টু গড়িয়া হ্যান্ডেল মেরে গেলাম সারাজীবন। এখন রাত করে যখন বাড়ি ফিরি, তখন আর বাড়ি ফিরতে ভাল লাগে না। মনে হয় কালীতলার মাঠে চাঁদের নীচে শুয়ে থাকি। চাঁদ কি আর শুধু ভদ্রলোকদের জন্য ওঠে। আমাদের জন্যও ওঠে। গড়িয়া থেকে সকালবেলা যে ফুটো মস্তানকে নিয়ে গেলাম যাদবপুরে, রাতের বেলা ফেরার জন্য সে যখন আমার অটোতে উঠল, কী তার তেজ! মনে হল হাতে মাথা কাটবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাপার? সে বলল, ‘‘সকালে ছিলাম ঘাস। এখন আমি পদ্ম। তোর ভাড়া কত রে?’’ কোনও অটোকে জীবনে প্রথম ভাড়া দিচ্ছে সে। ‘‘এই নে পঞ্চাশ। তোকে পুরোটাই দিয়ে দিলাম।’’ আমি ন্যায্য ভাড়াটুকু রেখে বাকিটা ফিরিয়ে দিলাম। কাল আবার যখন ফিরবে, তখন বলবে, ‘‘ঘাসফুল ছিলাম। ঘাসফুল আছি। ঘাসফুল থাকব।’’
ঘরে ফিরে স্নান করি প্রতিদিন। অটো চালালে প্রচুর ময়লা লাগে গায়ে। ধোঁয়া-ধুলো সামলাতে পারি। মানুষের ময়লা গায়ে লাগলে উঠতে চায় না। মানুষের ময়লা গায়ে লাগে না। মনে লাগে। মনে বসে যায়। ঝামা দিয়ে ঘষলেও ওঠে না। সেদিন বর-বউ এক সঙ্গে বাঘাযতীন থেকে উঠল। এ ওকে বলছে, ‘‘আমি কাল ব্রিগেড যাব। ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে— ওফফ্, গা গরম হয়ে যায় গানটা শুনলে। মনে হয়, আমি বাঘাযতীনের চে গুয়েভারা। আরও একটা গান, ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না। ওটাও দারুণ। তবে তুমি কাল বাড়ি থাকবে। বুঝেছ?’’
—বুঝেছি।
‘‘ঠিক বুঝেছ?’’
—তা আর বলতে।
‘‘মঙ্গলবার তিনটের সময় মুরলীধর লেনের পেছনে বাবাইয়ের চায়ের দোকানে চা খাবে। ওখানেই কথা পাকা হয়ে যাবে।’’
আমি আয়নায় দেখতে পেলাম, মহিলাটি ঘাড় নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। চে গুনগুন করে গাইছে, ‘‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে…।’’
আমি অটো চালাতে পারি। কিন্তু ‘কারা’ মানে জানি। আমি জানতে চাইলাম, দাদা, ‘কারা’ মানে কী? তিনি বললেন, ‘‘কারা মানে জেলখানা। হুঁ-হুঁ, আমরা জেনে গান করি। না জেনে করি না। আমরা শিক্ষিত। আমরা আদর্শ মেনে গান গাই। যে কোনও গান গাই না।’’ আমি আর পারলাম না। গেয়ে উঠলাম, ‘টুম্পাসোনা, তুমি ঢপ মেরো না’।
লোকটা অটো থেকে নেমে আমাকে বলল, ‘‘অটো চালানো বন্ধ করে দেব!’’
আজ আমি আর লাল্টু পাড়ার পেছনে সোনাপুকুরে এসে বসলাম। দুটো পাঁইট নিয়ে। বহুদিন মুখে দিইনি। ছেলেটা কলেজে যাবে। মেয়ে ক্লাস নাইনে। সাইকেল পেয়েছে। আগে খেতাম। কত রাত করেছি। মারপিট করেছি। অটো ইউনিয়ন করেছি। এখন আর ভাল লাগে না। আগে গলায় গামছা দিয়ে ধরে নিয়ে যেত মিছিলে। না গেলে ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দিত। এখন ধোপাও নেই, নাপিতও নেই। এখন কেউ ধরে নিয়ে যাওয়ার নেই। সোনাপুকুরে আগে নাকি সোনা পাওয়া যেত। সেই থেকে লোকে বলে সোনাপুকুর। কোনও এক ডাকাত অনেক সোনা ফেলে চলে গিয়েছিল। লাল্টু বলল, ‘‘এখন তো এই পুকুর হিরের পুকুর।’’ ঠিক হিরের নয়। মানিকের। মানিক মস্তানি করত। ২০০৫ সালে এই পুকুর নিয়ে একটা খুন হল। মানিক পালিয়ে গেল। লুকিয়ে থাকল। ২০০৮-এ ফিরে এল। কিচ্ছু হল না। ২০১১-তে এদিক থেকে ওদিকে চলে গেল। পুকুর ওর হাতেই থাকল। ভ্যান-বোঝাই হয়ে রুই কাতলা চলে গেল যাদবপুরের বাজারে। মানিক দোতলা তুলল। এখন মানিক জল মাপছে। পুকুরের ধারে বসে থাকে। মাঝে মাঝে ফাইভ ফিফটি ফাইভ ধরায়। মুখে পানপরাগ, কপালে তিলক কাটা তিনটে ছেলে এসে একদিন মানিকের মুখ থেকে ফাইভ ফিফটি ফাইভ কেড়ে সোনাপুকুরে ফেলে দিয়ে বলল, ‘‘এবার থেকে তোর আমার ফিফটি-ফিফটি। পুকুর থেকে যত সোনা উঠবে তার হাফ আমার। ঠিক আছে? এই ওর কপালে তিলক পরিয়ে দে!’’
আমি তিন ঢোঁকে পাঁইট শেষ করে লাল্টুকে বললাম, ‘‘আরেকটা করে হলে ভাল হত। এ তো মনে হল, কোষাকুষি থেকে চরণামৃত খেলাম। পাঁইটগুলোতে কি আজকাল কম দিচ্ছে?’’ লাল্টু মুখ মুছে বলল, ‘‘পুকুরের ধার দিয়ে কালো চকচকে রাস্তাটা চলে গিয়েছে দেখেছিস? প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মতো ঝকঝকে। চল্, রাস্তার ওপর ঘুমিয়ে পড়ি। তাহলেই প্রিয়াঙ্কার ওপর ঘুমিয়ে পড়া হবে।’’ আমি বললাম, বাড়ি যাব। কাল সকালে লাইনে দাঁড়াতে হবে। তুই কার্ড পেয়েছিস? মা-কে ভর্তি করে দিলাম হাসপাতালে। প্রথমে কার্ড নিচ্ছিল না। পরে নিল। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, লোকজন গুল মারছে। একটাও পয়সা লাগেনি। এ তো ম্যাজিক!
আমি বললাম, ‘‘চল্! ম্যাজিক বেরিয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে মেয়ের হাতে ঝাড় খাব।’’
মনমেজাজ ভাল ছিল না। কারণ, ৮৪৫ টাকা ৫০ পয়সা আজ গুনে গুনে দিয়েছি। দু’মাসে চারবার দাম বাড়ানোর জন্য নয়। বউ বলেছে, ‘‘তুমি আগে বাড়ি ফিরতে পার না? তোমার জন্য আবার গ্যাস জ্বেলে খাবার গরম করতে হয়।’’ আমার জন্য একবার গ্যাস জ্বালাতে হয়? ভাবা যায়? যাদের জন্য মুখে রক্ত তুলে অটো চালাই তাদের মুখে কী কথা! এইট বি’তে আমাদের একটা চায়ের দোকান আছে। আমাদের ঠেক। আজ আর খেপ মারব না। গিয়ে বসলাম ঠেকে। এটাই আমাদের কফি হাউস। এটাই আমাদের অটোচালকদের পার্লামেন্ট। বাবলু শাটল মারে বৈষ্ণবঘাটা পাটুলিতে। সবচেয়ে বেশি কথা বলে। আজ চুপ। বললাম, কি রে, গুম মেরে আছিস কেন? বাবলু বলল, ‘‘ফুলুরিতে ব্যথা হয়েছে।’’ বাবলু এ ভাবেই কথা বলে। বুঝে নিতে হবে ফুলুরি মানে কী। আরও দুজন অটোচালক একসঙ্গে বলে উঠল, ‘‘দেখি! তোর ফুলুরিটা দেখি!’’ বাবলু বলল, ‘‘বেশি ঘাঁটাস না। ঘ করে দেব।’’ তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে আমাকে বলল, ‘‘ছেলেটা দু’দিন বাড়ি ফেরেনি। ইলেকশনের ডেট বেরিয়ে গেছে। আর কোনও রেজাল্ট বেরুবে না। ছ’মাস বাদে, এক বছর বাদে আবার আশা দেখাবে। আপাতত আশা শেষ। এত ভাল লেখাপড়া করে কী হল? আমি পড়িনি। ছেলেটাকে তো পড়িয়েছি। এখন কি ওকে বলব, অটো চালা বাপের মতো? এত বেকার? কেন এত বেকার?’’
আমি বললাম, বাবলু, তোর দুঃখটা আমি বুঝি। কী করবি বল? সত্তর বছরে ওরা চাকরি দেয়নি। চৌত্রিশ বছরে এরা দেয়নি। বারো বছরে এরা দেয়নি। দশ বছরে এরাও দিল না।
আর এই হয়েছে ধর্ম! কেউ ভাত নিয়ে কথা বলে না। ভাত নিয়ে কোনও টেলিভিশনে আলোচনা হয়? ধর্ম-ধর্ম করে দেশটার হাড়পাঁজরা বেরিয়ে এল। মন্দির খেতে দিলে, মসজিদ খেতে দিলে আমি অটো চালাতাম না। কিচ্ছু না করে শুধু ঠাকুরদেবতার নাম করে ভোট চাওয়া যায়? যারা চেয়ে আসছে তাদের আবার চাইছে। মেনে নিলাম। কিন্তু ব্রিগেডে চে গুয়েভারা কেন ধর্মের সঙ্গে কোলাকুলি করবে?
চে গুয়েভারা না চে ফুরফুরা? আমি কে? আমি অটোওয়ালা। আমি নন-গ্র্যাজুয়েট। বলতে পারব না। যাঁরা সেলিব্রিটি তাঁরা বলতে পারবেন।
(লেখক অধ্যাপক ও কবি। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy