লড়ছেন যারা: পার্থ ভৌমিক (বাঁ দিকে উপরে), বিশ্বজিৎ দাস (উপরে মাঝখানে), নরুল ইসলাম (বাঁ দিকে নিচে), কাকলি ঘোষ দস্তিদার ( নিচে মাঝখানে)। সরলেন যারা: নুসরত জাহান(ডান দিকে উপরে), অর্জুন সিংহ (ডান দিকে নিচে)। নিজস্ব চিত্র।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তো ছিলই, তার উপরে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, শেখ শাহজাহানদের মতো নেতারা জেলে। গত লোকসভা ভোটে উত্তর ২৪ পরগনার দু’টি আসন, বনগাঁ ও ব্যারাকপুর হাতছাড়া হয়েছিল তৃণমূলের। এই পরিস্থিতিতে এই জেলায় এ বার লোকসভা ভোট তৃণমূলের কাছে কার্যত ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। গোষ্ঠীকোন্দলে জেরবার ব্যারাকপুরে এ বার ‘দিদি’র বাজি নৈহাটির বিধায়ক, রাজ্যের সেচমন্ত্রী পার্খ ভৌমিক। বসিরহাটের সাংসদ নুসরত জাহানকে নিয়েও দীর্ঘ দিন ধরে অসন্তোষ জানাচ্ছিলেন স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। সেখানেও ফিরিয়ে আনা হয়েছে হাজি নুরুল ইসলামকে, যিনি ২০০৯ সালেও এই কেন্দ্রে প্রার্থী হয়ে জিতেছিলেন।
বনগাঁ লোকসভা আসনে তৃণমূল প্রার্থী হয়েছেন বিশ্বজিৎ দাস। বাগদার বিধায়ক এবং তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বিশ্বজিতের নাম এই আসনে কিছু দিন ধরেই তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছিল। রবিবার বিগ্রেডের সভা মঞ্চ থেকে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বজিতের নাম ঘোষণা করতেই বনগাঁয় দলের কর্মী-সমর্থকেরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। বিভিন্ন এলাকায় আবির খেলা শুরু হয়। চলে মিষ্টিমুখ করানোর পালা। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্বজিতের ছবি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে শুরু করেন কর্মীরা।
বিশ্বজিৎ তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে দলের সঙ্গে ছিলেন। পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য ছিলেন। ২০১১ এবং ২০১৬ সালে পর পর দু’বার বনগাঁ উত্তর কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়ে
বিধায়ক হন।
২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের পরে বনগাঁ পুরসভার তৎকালীন পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্যের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছিলেন তৃণমূলের কয়েক জন কাউন্সিলর। তারপরেও দল শঙ্করকে পুরপ্রধানের পদ থেকে সরাতে গড়িমসি করে। কয়েক জন কাউন্সিলর সহ বিশ্বজিৎ দিল্লি গিয়ে বিজেপিতে যোগদান করেন।
তবে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক বজায় ছিল। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে মুখে বিধানসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পা ছুঁয়ে নমস্কারও করেছিলেন। সে বার বিজেপি টিকিটে দাঁড়িয়ে বাগদা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে বিধায়ক হন। ভোটের পরে তৃণমূলে যোগদান করেন। কিন্তু বিধায়ক পদে ইস্তফা দেননি। ফলে খাতায়-কলমে বিশ্বজিৎ এখনও বিজেপির বিধায়ক।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা বিশ্বজিৎকে দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি করা হয়। দলের থেকে ইঙ্গিত পেয়ে নবজোয়ার কর্মসূচির সময় থেকে নাগাড়ে গ্রামে ঘুরে জনসংযোগের কাজ করছিলেন বিশ্বজিৎ। লোকসভায় প্রার্থী হওয়ার আগে বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেবেন বলেও জানিয়েছেন। ফলে বাগদা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হবে।
বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে প্রার্থী করায় আমি কৃতজ্ঞ। জয়ী হয়ে তাঁদের আস্থার মর্যাদা রক্ষা করব।’’
এ দিন ঠাকুরনগরে মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে এসে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী কড়া ভাষায় বিশ্বজিৎ দাসকে আক্রমণ করেন। তাঁকে ‘বহুরূপী’ ও ‘কাকতাড়ুয়া’র সঙ্গে তুলনা করেন। শুভেন্দুর কথায়, "বিধানসভার ভিতরে বিজেপির বিধায়ক, বাইরে তৃণমূলের চোরদের জেলা সভাপতি। এখন তো পদত্যাগ করে ভোটে দাঁড়াতে হবে। আম-ছালা দু’টোই যাবে।" বিশ্বজিৎকে হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, "শঙ্কর আঢ্য যেখানে, আপনাকেও সেখানে যেতে হবে। তৈরি থাকুন।" প্রসঙ্গত, রেশন বণ্টন দুর্নীতি মামলায় ইডির হাতে গ্রেফতার হয়ে শঙ্কর এখন জেলে।
অন্য দিকে, বসিরহাট কেন্দ্র থেকে তৃণমূল প্রার্থী করেছে হাড়োয়ার বিধায়ক হাজি নুরুল ইসলামকে। এখানে বর্তমান সাংসদ নুসরত জাহান। দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে নুসরতের কাজকর্মে এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ। সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে তাঁর মুখে কার্যত কোনও কথাও শোনা যায়নি। মানুষ বিপদে-আপদে, প্রয়োজনে তাঁকে কাছে পায়নি বলে অভিযোগ। এলাকায় আসতেন খুব কম। দলের নেতা-কর্মীরাই অনেকে দাবি তুলেছিলেন, স্থানীয় কাউকে প্রার্থী করা হোক।
কেন নুরুলকে বেছে নেওয়া হল?
দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, বসিরহাট লোকসভা মূলত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। দল চেয়েছিল সংখ্যালঘু কোনও পরিচিত মুখকে প্রার্থী করতে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বসিরহাটের সাংসদ ছিলেন নুরুল। গোটা লোকসভা এলাকায় তাঁর পরিচিতি আছে।
কয়েক মাস আগে নুরুলকে তৃণমূলের বসিরহাট সাংগঠনিক জেলার সভাপতি করা হয়েছিল। সভাপতি হয়ে তিনি গোষ্ঠীকোন্দল মেটাতে পদক্ষেপ করেন বলে দলীয় সূত্রের খবর। অভিষেকের সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে। প্রার্থী হতে পেরে নুরুল দলনেত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
বসিরহাটের বিধায়ক তথা তৃণমূল নেতা সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কাজের মানুষ নুরুল ইসলাম। দিদি এমন এক জনকে প্রার্থী করায় খুব ভাল হয়েছে।’’
বারাসত কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী হয়েছেন এই কেন্দ্রের তিন বারের সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও আমার প্রতি আস্থা রাখায় আমি কৃতজ্ঞ।’’
তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, প্রত্যাশা মতোই কাকলি প্রার্থী হয়েছেন। এখানে বিকল্প কোনও নাম ছিল না। অভিষেকের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা কাকলির প্রার্থী হওয়ায় কেউ অবাক হননি। হাবড়ার বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সঙ্গে কাকলির মতপার্থক্যের কথা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে এসেছে। রেশন বণ্টন দুর্নীতি মামলায় জ্যোতিপ্রিয় জেলে যাওয়ার পর থেকে হাবড়ায় কাকলির আনাগোনা বেড়েছিল।
ব্যারাকপুরে রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ ভৌমিকের নাম ঘোষণা করেছে তৃণমূল। এই সিদ্ধান্ত খানিকটা অপ্রত্যাশিতই ছিল ব্যারাকপুরবাসীর কাছে। যে ভাবে ২০১৯ সালে দল ছেড়ে বিজেপির টিকিটে দাঁড়িয়ে তৃণমূল প্রার্থী দীনেশ ত্রিবেদীকে বিপুল ভোটে হারিয়েছিলেন অর্জুন সিংহ, তাতে তাঁকে দলে ফেরানোটা জরুরি হয়েছিল। ২০২২ সালের ২২ মে শ্যামনগরে জনসভায় অর্জুনের হাতে ফের দলীয় পতাকা তুলে দেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বারও তাঁর টিকিট পাওয়া শুধু তালিকা ঘোষণা হওয়ার অপেক্ষা বলে ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন অর্জুন। যদিও অর্জুনের বিরুদ্ধে কয়েক মাস ধরে সরব ছিলেন পার্থ-ঘনিষ্ঠ বিধায়ক সোমনাথ শ্যাম, সুবোধ অধিকারীরা। গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে অর্জুনকে প্রার্থী না করার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আর্জি জানান তাঁরা।
এ দিন অর্জুনের অনুগামীরা দত্তপুকুর-সহ ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ দেখান, পথ অবরোধ করা হয়। অর্জুন বলেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করেছিলাম, দল বিশ্বাসঘাতকতা করল। সব কিছু আবার নতুন করে ভাবতে হবে খুব দ্রুত। পার্থ ভৌমিককে শুভেচ্ছা।’’ পার্থের প্রতিক্রিয়া, ‘‘শুভেচ্ছা তো আমাকে আপামর ব্যারাকপুরবাসী জানিয়েছেন। এই আসনে দাঁড়ানোর মতো সত্যিই তো কেউ ছিলেন না, যিনি মানুষের পাশে থাকেন, মানুষের মন বোঝেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy