প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
তিনি ‘সর্বগুণসম্পন্ন’। তিনি ‘প্রজাবৎসল’। তিনি ‘বীর’। তিনি ‘সুশাসক’।
রামের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর সরাসরি তুলনাটাই শুধু করলেন না। তা না করলেও আজ অমিত শাহ লোকসভায় দাঁড়িয়ে বোঝালেন, রামের সব গুণই নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে রয়েছে। গোটা দেশ বহু বছর ধরে এমন ‘সর্বগুণসম্পন্ন’ প্রধানমন্ত্রীর অপেক্ষাতেই ছিল। আর তাই রামমন্দিরের নির্মাণ ও রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্ব ছাড়া সম্ভব ছিল না।
২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন ও রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার পরে প্রশ্ন উঠেছিল, ভারত কি সংখ্যাগুরুবাদ ও একনায়কতন্ত্রের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল?
আজ অমিত শাহ সংসদে দাঁড়িয়ে যুক্তি দিলেন, বিশ্বের আর কোনও দেশে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় নিজের ধর্মবিশ্বাসের জন্য এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেনি। এতে গোটা বিশ্বের সামনে ভারতের ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র’-ই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৫২৮ সাল থেকে রামমন্দিরের জন্য লড়াই শুরু হয়েছিল। ১৮৫৮ থেকে শুরু হয়েছিল আইনি যুদ্ধ। ২২ জানুয়ারি রামমন্দিরে উদ্বোধন ও রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই লড়াই শেষ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির রায়ের পরে ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ আবহ’-এর মধ্যেই রামমন্দির নির্মাণ হয়েছে।
শনিবার ছিল লোকসভা ভোটের আগে সংসদের অধিবেশনের শেষ দিন। সেই দিনেই সুকৌশলে বিজেপি নেতৃত্ব লোকসভা ও রাজ্যসভায় ‘ঐতিহাসিক রামমন্দিরের নির্মাণ ও রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, রামমন্দির ঘিরে ভাবাবেগকে সংসদের অন্দরে নিয়ে আসা ও মোদী সরকারের সাফল্য হিসেবে রামমন্দিরের প্রতিষ্ঠায় সংসদের সিলমোহর আদায় করে নেওয়া। বিজেপি নেতারা জানতেন, বিরোধীরা রামমন্দির নির্মাণের বিরোধিতা করতে পারবেন না।
সংসদের দুই কক্ষেই বিজেপি-সহ শাসক শিবিরের সাংসদরা রামের গুণগান করেছেন। লোকসভায় দিল্লির গায়ক-সাংসদ হংস রাজ হংস রামের ভজনও গেয়েছেন। তাতে সবাই তালে তালে হাতে তালি দিয়েছেন। রামমন্দিরের জন্য নরেন্দ্র মোদীকেই ‘ধন্য ধন্য’ করেছেন বিজেপির সাংসদরা। আর তার মাধ্যমে রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা নিয়ে আলোচনা আদতে নরেন্দ্র মোদীকে ‘সর্বগুণসম্পন্ন’ শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করারও মঞ্চ হয়ে উঠেছে। লোকসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও রাজ্যসভায় বিজেপির জাতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডা তাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
লোকসভায় অমিত শাহ আজ বলেছেন, চৈতন্যদেব থেকে রামানন্দের মতো অনেকেই এ দেশে ভক্তি আন্দোলন করেছেন। তাতে দেশ মজবুত হয়েছে। সনাতন ধর্মের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। ভক্তি আন্দোলনের পুরোধারা জনমানসকে দিশা দেখিয়েছেন। কিন্তু ভারতের হাজার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে আর কোনও শাসক বা জনপ্রতিনিধি এ ভাবে ভক্তি চেতনার পুনর্জাগরণে নেতৃত্ব দেননি। রামমন্দিরের ভূমিপুজো থেকে মন্দিরের নির্মাণ ও রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে কাজ নরেন্দ্র মোদী করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘লালকৃষ্ণ আডবাণী রামমন্দির নিয়ে জনজাগরণ ঘটিয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদী ভক্তি চেতনার জাগরণ ঘটিয়েছেন।’’ অমিত শাহ এ দিন সংসদে বুঝিয়ে দেন, মোদী একাধারে রাজা হিসেবে সুশাসক এবং ঋষির মতো আধ্যাত্মিক চেতনা জাগিয়ে তুলেছেন ভারতে।
এখানেই রামমন্দির আন্দোলন ও আইনি লড়াইয়ের যাত্রাপথের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর দশ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বের তুলনা টেনেছেন অমিত শাহ। যুক্তি দিয়েছেন, মোদী সুশাসকের মতো কোভিড অতিমারির সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাষট্টি সালের মতো চিন অনুপ্রবেশ করলে তা বীরের মতো রুখে দিয়েছেন। পুঞ্চ থেকে পুলওয়ামায় হামলা হলে মোদী পাকিস্তানের ঘরে ঢুকে জবাব দিয়েছেন। আবার পড়ুয়ারা চাপে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে দেখে ‘প্রজাবৎসল’ নরেন্দ্র মোদী পিতার মতো তাঁদের সঙ্গে ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ করেছেন। অমিত শাহের বক্তৃতার সময় লোকসভায় বারে বারে ‘জয় শ্রী রাম’-এর জয়ধ্বনি উঠেছে।
শাহ বলেন, মোদীর নেতৃত্ব ছাড়া রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না। কারণ সুপ্রিম কোর্টের রামমন্দিরের পক্ষে রায়ের পরে অনেকেই দেশে রক্তপাত, হিংসার আশঙ্কা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদী জয়-পরাজয়ের ভাবনা থেকে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে দেখেননি। দেশের ১৪০ কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি রামমন্দিরের ভূমিপুজো ও রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই রামমন্দির আন্দোলনের সময় যে ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি উঠেছিল, যা রামায়ণের বানরসেনার যুদ্ধঘোষণার মন্ত্র ছিল, তা রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠার সময় ভক্তির মন্ত্র ‘জয় সিয়ারাম’-এ পরিবর্তিত হয়ে যায়।
কংগ্রেস-এনসিপি-র মতো বিরোধী দলের নেতারা আজ বলেছেন, একা বিজেপি রামের ভক্ত নয়। সবাই রামের ভক্ত। মোদী সরকারের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন করলেও বিতর্কের মধ্যে জড়াতে চাননি। কিন্তু এমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বলেছেন, যেখানে রামমন্দির তৈরি হয়েছে, সেখানে বাবরি মসজিদ ছিল, আছে, থাকবে। তিনি ‘বাবরি মসজিদ জিন্দাবাদ’ ধ্বনিও তুলেছেন লোকসভায়। অমিত শাহ বিরোধীদের বলেছেন, যজ্ঞে বাধা না দিয়ে বিরোধীদের উচিত এই আধ্যাত্মিক জাগরণের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া। তাতেই দেশের মঙ্গল। কারণ রামমন্দিরের প্রতিষ্ঠা নতুন যুগের সূচনা। ২০২৪-এ ফের নরেন্দ্র মোদীর সরকার তৈরি হবে। তার পরে বিকশিত ভারতের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু হবে। রামমন্দিরকে ধর্মান্ধতার সামনে আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হিসবে তুলে ধরেছেন শাহ। বিজেপি নেতারা স্লোগান তুলেছেন, এ বার ওয়েইসিকেও ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে হবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy