—গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে ‘নারদকাণ্ড’ ফাঁস হয়েছিল। টেলিভিশন স্ক্রিনে দেখা গিয়েছিল শাসকদলের নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদেরা হাত পেতে টাকা নিচ্ছেন। রাজনৈতিক মহলে শোরগোল উঠলেও সেই ভোট বৈতরণী পার হতে তৃণমূলকে ততটাও বেগ পেতে হয়নি। ‘বিড়ম্বিত’ হলেও শেষ পর্যন্ত ভোট করে নিতে পেরেছিল তৃণমূল। কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের ছ’দফা বাকি থাকার আগে হাই কোর্টের রায়ে চাকরি খুইয়েছেন প্রায় ২৬ হাজার জন। এই রায়ে নতুন করে শোরগোল শুরু হয়েছে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে। এবং ঘরোয়া আলোচনায় তৃণমূলের নেতারা মেনে নিচ্ছেন, নারদকাণ্ডের থেকে এই ঘটনা ভোটে অনেক বেশি ‘অভিঘাত’ তৈরি করবে। দলকে অনেক বেশি ‘বিড়ম্বনায়’ পড়তে হবে।
সোমবার কলকাতা হাইকোর্টের ওই রায়ের প্রেক্ষিতে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাপচক্রে দলকে এই জায়গায় এসে পড়তে হয়েছে। অনেক আগেই এটা আটকানো যেত। কিন্তু দলে পার্থেরাই একটা সময়ে ছড়ি ঘোরাতেন।’’ পাশাপাশিই কুণাল এ-ও বলেছেন, ‘‘মানুষ নিশ্চয়ই বুঝবেন মমতাদি (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) এবং অভিষেক (তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়) বিষয়টি জানার পরেই ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিছু ভুল নিশ্চয়ই হয়েছিল। কিন্তু আদালতের রায়ে যোগ্যদেরও চাকরি কেড়ে নেওয়া হয়েছে!’’ তৃণমূলের প্রবীণ নেতা তথা দমদম লোকসভার প্রার্থী সৌগত রায়ের বক্তব্য, ‘‘অনেক কিছুরই তো মুখোমুখি হয়েছি। এ বার এটারও হব। পার্থ জেলে রয়েছে। এখন এ সব ভেবে কী করব? আমাদের কথা মানুষের কাছে বলতে হবে।’’
নারদের গোপন ক্যামেরা অপারেশনে সৌগতকেও টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল। এ-ও শোনা গিয়েছিল, তিনি টাকা নিয়ে বলছেন, ‘‘সো মাচ মানি! থ্যাঙ্ক ইউ।’’ কিন্তু সৌগত-ঘনিষ্ঠেরা বলছেন, নারদের থেকেও নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল অনেক বড় ঘটনা। এর অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হতে পারে। তবে এর দায় সবটাই গিয়ে পড়ছে জেলবন্দি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থের উপর। যেমন তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতা বলেই ফেলেছেন, ‘‘ইচ্ছে করছে জেলে গিয়ে পার্থটাকে কষিয়ে একটা চড় মেরে আসি!’’
বস্তুত, নারদকাণ্ড ছিল তৃণমূলের কয়েক জন নেতাকে জড়িয়ে। কিন্তু নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতীর চাকরি এবং ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িয়ে। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে নারদকাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরে নির্বাচনী প্রচারসভায় মমতা বলেছিলেন, আগে জানলে তিনি ওই অভিযুক্তদের ভোটে মনোনয়ন দিতেন না। ভোটের ফলাফলে প্রমাণ হয়েছিল, জনতা মমতার কথায় আস্থা জানিয়েছিল। উপরন্তু, ২০১৬ সালে মমতার সরকার মাত্রই পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু ২০২৪ সালে যে মমতা বিজেপির বিরুদ্ধে রাজ্যে লড়ছেন, তিনি তৃতীয় বার মুখ্যমন্ত্রিত্বে এসেছেন। এবং এই প্রথম একটি ভোটের আগে তৃণমূলের দু’জন মন্ত্রীকে দুর্নীতির অভিযোগে জেলে যেতে হয়েছে। প্রথম জন পার্থ। দ্বিতীয় জন জ্যোতিপ্রিয় (বালু) মল্লিক। ফলে পরিস্থিতি এ বার ‘কঠিন’ বলে শাসক শিবিরের অন্দরেও আলোচনা শুরু হয়েছে। কারণ, এ বার ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’র পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়। ২০১৬ সালে বাম-কংগ্রেসের জোট বিরোধী শিবিরে থাকলেও তারা বিষয়টি নিয়ে সে ভাবে ‘জলঘোলা’ করতে পারেনি। কিন্তু নিয়োগ দুর্নীতি যখন প্রকাশ্যে এসেছে, তত দিনে বিরোধী পরিসরে পোক্ত জায়গা করে নিয়েছে বিজেপি। নিয়োগ দুর্নীতিতে একের পর এক সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়ে শিরোনামে থাকা বিচারপতি চাকরি ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। সেই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় লোকসভা ভোটেও লড়ছেন। অনেকের মতে, জনমানসে তৃণমূল সম্পর্কে যে ‘নেতিবাচক’ ধারণা তৈরি হয়েছিল, যখন মমতা-অভিষেক তা প্রতিহত করার চেষ্টা করছেন, তখন হাই কোর্টের রায় নতুন করে শাসকদলের ‘ক্ষত’ তৈরি করে দিল। ভোটের মধ্যে তাতে প্রলেপ দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান তৃণমূলের একাংশ।
তবে আবার অন্য একাংশের মতে, এর ‘দায়’ যাবে পুরোপুরি হাই কোর্টের উপর। কারণ, রায় দিয়েছে হাই কোর্ট। শাসক শিবিরের এই অংশ বলছে, অভিযুক্তদের সঙ্গেই যোগ্যদেরও চাকরি বাতিল করে দিয়েছে আদালত। সেটা জনতা বুঝবে। তবে একই সঙ্গে সেই অংশের বক্তব্য, ভোটের প্রচারে বিষয়টা বোঝাতে হবে। যে সূত্রে মনে করা হচ্ছে, সরকারের ‘ইতিবাচক’ দিকগুলি চিহ্নিত করার বদলে এ বার ‘ক্ষত’ নিরাময়ে বেশি সময় দিতে হবে। বেশি চেষ্টা করতে হবে। ফলে প্রচারের অভিমুখও ঘুরে যাওয়ার সম্ভাবনা। তৃণমূলের আইনজীবী নেতা তথা শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, ‘‘এই রায় ত্রুটিপূর্ণ। এই নির্দেশ দেওয়া যায় না। সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ মিনিটে এই রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দেবে।’’ কল্যাণের অভয়বাণী: ‘‘কারও কোনও চিন্তার কারণ নেই।’’
প্রত্যাশিত ভাবেই বিরোধীরা বিষয়টি নিয়ে ময়দানে নেমে পড়েছেন। তাঁদেরও মতে, নারদের থেকেও বড় ‘বিড়ম্বনা’ নিয়োগ বাতিল। বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ তথা রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘২০১৬ সালে ছিল বিধানসভা ভোট। এ বার দেশের ভোট। এই ভোটে মানুষ ঠিক করে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীকেই ফেরাবেন। সেই আবহে নিয়োগ বাতিল তৃণমূলের কাছে গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে হাজির হয়েছে।’’ রাজ্যসভায় সিপিএম সাংসদ তথা আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘নারদের সঙ্গে এর কোনও তুলনাই হয় না। কারণ, ওটা কয়েক জনের বিষয় ছিল। তাঁদের কেউ কেউ এখন বিজেপিতে। কিন্তু নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে গোটা সমাজ জড়িয়ে রয়েছে। তৃণমূল এই ভোটে জবাব পাবে।’’ উত্তর কলকাতার কংগ্রেস প্রার্থী প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কাদের পাপের ফলে ওই ২৬ হাজার ছেলেমেয়ের চাকরি গেল? যারা সেই পাপ করেছে তাদের নির্বাচনে পরাস্ত করে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। আশা করি বাংলার জনগণ সেই কাজ করবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy