Advertisement
E-Paper
BB_2025_Lead Zero Banner

মনে মনে তাঁদের আমরা ঈশ্বর বানিয়েছি

এক জন ধোনি, একজন কোহালি বা এক জন রোহিত শর্মা তো পারেন ম্যাচের ভাগ্য বদলে দিতে। বারবার সেটা দেখেছিও আমরা। ভাগ্য বদলে দেওয়া আর তাঁদের উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা কিন্তু এক নয়। কিন্তু ভারতবর্ষের মতো দেশে এই প্রবণতা থেকে তো আমরা মুক্ত হতে পারছি না। লিখছেন সন্দীপন রায়।বেহাল অর্থনীতি, রাজনৈতিক আস্থাহীনতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, ধর্ষণ থেকে নারী নির্যাতনের মতো জ্বলন্ত সমস্যাগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আলোচনা হয় না।

 ভারত-নিউজ়িল্যান্ড ম্যাচে ধোনির আউটের মুহূর্ত। ফাইল চিত্র

ভারত-নিউজ়িল্যান্ড ম্যাচে ধোনির আউটের মুহূর্ত। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৯ ০০:৫৭
Share
Save

একটা রানআউট। আর তার সঙ্গেই আপামর ভারতবাসীর আরও একবার বিশ্বজয়ের স্বপ্ন শেষ! না বিশ্বজয় অর্থে কোন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বিজ্ঞান বা শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রতিযোগিতার কথা বলছি না। এটা বোঝার জন্য কোনও পুরস্কারও নেই। বলছি, সদস্য শেষ হওয়া বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কথা। এবং পৃথিবীর দুই শতাধিক দেশের মধ্যে মাত্র, হ্যাঁ মাত্র ১০টি দেশ এই বিশ্বজয়ের রণাঙ্গনে লড়াইয়ে আসীন ছিল। ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তব। আর তাই গত ১০ই জুলাই, ২০১৯ তারিখে সর্বকালের অন্যতম সেরা ফিনিশারের তকমা লেগে থাকা মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ওই রান আউটের পরে শুধু ভারতবর্ষের বাসিন্দারা নন, পৃথিবীর সর্ব গোলার্ধের সকল স্থানে ছড়ানো ছিটানো জন্মসূত্রে ভারতীয়েরাও চরম বিষাদে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন। কারণ, সেই আউটের সঙ্গে সঙ্গেই সকলে বুঝে গিয়েছিলেন, এ বারের মতো বিশ্বকাপ অভিযান শেষ ভারতের।

যত দিন বিশ্বকাপ ছিল আমাদের আর কোনও কিছু নিয়ে ভাবারও সময় ছিল না। দেশের যাবতীয় সমস্যা তখন ‘ব্যাকবেঞ্চে’। মন জুড়ে শুধুই ক্রিকেট। শুধুই ধোনি, কোহালি, রোহিত, বুমরারা। ঠিক সেই ভাবেই নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওই সেমিফাইনাল ম্যাচে ধোনির রান-আউটের পরেও চুলচেরা বিশ্লেষণে নিমগ্ন ক্রিকেট প্রেমী ভারতীয়েরা। ওই রানআউটের বাইরেও আরও নানা ভুল-ভ্রান্তি অন্বেষণে ব্যস্ত। প্রথম একাদশে মহম্মদ শামির না থাকা, দুরন্ত ফর্মে থাকা ওপেনার রোহিত শর্মার এই ম্যাচে ব্যর্থ হওয়া, দলের অধিকাংশ ব্যাটসম্যানের রান না পাওয়া, ধোনিকে ব্যাটিং লাইন-আপে আরও একটু আগে না-নামানো, অধিনায়ক বিরাট কোহালির মতো বিশ্বমানের ব্যাটসম্যানের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে রান না পাওয়া ইত্যাদি নানা বিষয় বাড়ির ড্রইংরুম, চায়ের ঠেক, অফিস, বাস, ট্রেন সমস্ত স্থানে আলোচনার প্রথম সারিতে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু, সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে মাথাচাড়া দিয়ে থেকেছে সেই একটি নাম— মহেন্দ্র সিংহ ধোনি।

ঠেকে ঠেকে সে কী তুফান উঠেছিল সে দিন! ধোনি কি পারতেন না তাঁর শরীরটি ভাসিয়ে দিয়ে পৌঁছে যেতে ক্রিজের সেই প্রত্যাশিত সীমারেখায়, ফিল্ডারের সরাসরি থ্রোয়ে বলটি উইকেট ছোঁয়ার আগেই। যদি তিনি পারতেন তা হলে তিনি কি সেই আপাত অসম্ভবের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে প্রতিটি ভারতবাসীর হাতে আবারও একবার বিশ্বকাপের দুর্মূল্য ট্রফিটি এনে দিতে পারতেন না? বিজ্ঞেরা বলে দিলেন, বয়স হলে ফিটনেস যে কমে যায়, সেটা ধোনি কবে বুঝবেন। ধোনিকে দল কত দিন বহন করবে, উঠে গেল সে প্রশ্নও।

আর এই রকমারি প্রশ্নের ঘূর্ণিপাকে আবদ্ধ ভারতবর্ষ প্রকৃতির খুব স্বাভাবিক নিয়মেই আবার কর্মচঞ্চল বাধ্যবাধকতার জীবনে ফিরে আসবে। কিছু কিছু প্রশ্নের মীমাংসা থেকে যাবে অধরা। আলোচনা, বিতর্কের পরিসরে আমরা ভুলতে থাকব ক্রিকেট এগারো জনের খেলা। কোনও এক জনের সাফল্য বা ব্যর্থতা একটি খেলার সামগ্রিক ফলাফলে সব সময় প্রভাব বিস্তার করে না। কিন্তু, সত্যিই কি তাই? এক জন ধোনি, একজন কোহালি বা এক জন রোহিত শর্মা তো পারেন ম্যাচের ভাগ্য বদলে দিতে। বারবার সেটা দেখেছিও আমরা। ভাগ্য বদলে দেওয়া আর তাঁদের উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা কিন্তু এক নয়। অন্তত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ভারতবর্ষের মতো দেশে এই প্রবণতা থেকে তো আমরা মুক্ত হতে পারছি না। আমরা মনে করি, অমুক তো এখনও আছে। ঠিক ম্যাচ বার করে দেবে। মনে মনে তাঁদের যে আমরা ঈশ্বর বানিয়েছি!

এবং এখানেই আমাদের মতো দেশের মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। বেহাল অর্থনীতি, রাজনৈতিক আস্থাহীনতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, ধর্ষণ থেকে নারী নির্যাতনের মতো জ্বলন্ত সমস্যাগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আলোচনা হয় না। এ ব্যাপারে আমরা ভারতবাসীরা এক অদ্ভুত অতুলনীয় মানসিক পরিকাঠামোর অধিকারী। এই মানসিক পরিস্থিতিতে বাঁচার প্রতিটি পদক্ষেপে এসে পড়া অসন্তোষগুলি নিজেদেরকে বাস্তব, চিরস্থায়ী, ধ্রুব সত্যে পরিণত করে চলেছে। তাই এগুলিকে আর আমরা সমস্যা বলে মনে করি না।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও আমাদের দেশের স্বাভাবিক জনজীবনকে ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। উপরে উল্লেখিত অসন্তোষের কারণগুলি জনবিস্ফোরণের ফলে সমাধানের কোনও পথ খুঁজে পায় না। ফলত, এক অবর্ণনীয় মানসিক অবস্থার মধ্যে আমাদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকা। এ ভাবে প্রাণধারণ করতে করতে এমন এক ভাবনাচিন্তায় আমরা অভিযোজিত হতে থাকি, যেখান থেকে জন্ম নেয় এক নায়ক-পুজোর মূল্যবোধ। নায়ক-পুজোর সঠিক ইংরেজি ভাষান্তর হয়তো ‘Hero Worship’। তখন আমরা ভাগ্য-পীড়িত জাতি খুঁজে পেতে চাই এমন এক মানুষকে, যিনি আমাদের সামনে ‘অতিমানব’ হয়ে উঠবেন। যাঁকে আশ্রয় করে আমরা আমাদের সব অপূর্ণতাকে ভুলে যেতে পারব। যাঁর নায়কোচিত (অথবা অতিনায়কোচিত) কর্মকাণ্ডের মধ্যে চাইব নিজেদের হারিয়ে ফেলতে। এই হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেই রয়েছে নিজেকে ভুলে যাওয়া, নিজের সমস্ত অপ্রাপ্তিকে ভুলে খুঁজে পাওয়া এক নৈসর্গিক মুক্তির আস্বাদ। সিনেমা হলের আড়াই ঘণ্টায় যেমন মানুষ চায় সব কিছুকে ভুলে থাকতে। বিশ্বাস করতে ভালবাসে, নায়ক তো নায়কই। দশ-বিশ জন গুন্ডা পেটানো তার কাছে ছেলেখেলা।

এই অনির্বচনীয় মুক্তিরই ভারতবর্ষে আর এক নাম ক্রিকেট। সেই ক্রিকেট হয়ে ওঠে আমাদের মাথা তুলে উঠে দাঁড়ানোর অন্যতম মাধ্যম। তাই তো নানাবিধ অসন্তোষের পাহাড়ের বোঝা বইতে বইতে ক্লান্ত মেরুদণ্ড একটু হাসার, আনন্দে ভাসবার কারণ খুঁজে পায় কপিল দেবে, গাভাসকারে, সচিন তেন্ডুলকরে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ে, এম এস ধোনিতে কিংবা বিরাট কোহালিতে। নিজেদের অজ্ঞাতসারেই এঁরা আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঈশ্বরের আসন লাভ করেন। এঁদের হাতে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা উঠে আসার সমার্থক হয়ে ওঠে বেকারের চাকরি পাওয়া, অভূক্ত ভারতের অন্নপ্রাপ্তির মতো অগনিত না পাওয়ার স্বপ্নপূরণে। আবেগ-সিঞ্চিত মনে যুক্তির কোনও প্রবেশাধিকার থাকে না। আমরাও তাই ক্রিকেটকে নিয়ে বেঁচে থাকি জীবনের সমস্ত দুঃখ হরণের অঙ্গীকারে। এই তথাকথিত ‘ইশ্বর’-দের নিয়ে আমরা বছর মেতে থাকি, যা একেক সময় চেহারা নেয় এক গণ-হিস্টিরিয়ায় |

যতদিন না আমাদের অস্তিত্বের অধিকার, কর্তব্যের পাওয়া না পাওয়াগুলি সুশৃঙ্খল হবে, ততদিন আমরা এ ভাবেই ক্রিকেটকে লক্ষ্য করে, ক্রিকেটকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়াতেই থাকব। কারণ, আমাদের সামনে একবুক আবেগ নিয়ে দৌড়ে চলেছেন যশপ্রীত বুমরা। বুমরার হাতের বল আসলে ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়ে জেগে থাকা অসংখ্য ভারতবাসীর দুই চোখের জীবন্ত স্বপ্ন।

(লেখক সিউড়ি চন্দ্রগতি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক,মতামত নিজস্ব)

ICC World Cup 2019 Mahendra Singh Dhoni India

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।