Advertisement
E-Paper

একটা অন্য রকম গল্প

এমন কথা কি রোজ রোজ শোনা যায়?  ভাগ্যিস দলিত মেয়েদের সম্মেলনে এসে পড়েছেন কলা লাউরে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২৩:৩৪
Share
Save

মেয়েদের জীবনের ঝাঁপিতে চিরকাল সুখের চাইতে দুঃখই বেশি। মুখ খুলল কি না খুলল, ‘‘সে যে কী দিন গিয়েছে দিদি...।’’ অধিকাংশ কাহিনিই বড় চেনা। বালিতে ঢেউয়ের নকশার উপর আরও একটা ঢেউয়ের দাগ। কদাচিৎ, জীবনদেবীর কৃপা হলে নতুন গল্প শোনা যায়। মধ্যপ্রদেশের গাঁয়ের দলিত মেয়ে কলা লাউরে বেশ তরিবত করে চাতালে বসে যখন বলল, ‘লিখো, গাঁও ভেরচা, ডিস্ট্রিক সারজাপুর, কাস্ট বাল্মীক’ তখন পুণের সাবিত্রীবাই ফুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কথা যত এগোচ্ছে, ল্যাম্পপোস্টের আলোটা যেন ততই ঝুঁকে পড়ছে মাথার ওপর। পিঠের কাছে আরও ঘনিয়ে আসছে কেয়ারি-করা গাছগুলো। কুকুরগুলো ঝগড়া থামিয়ে চাতালে পেট পেতে শুয়ে পড়েছে।

এমন কথা কি রোজ রোজ শোনা যায়?

ভাগ্যিস দলিত মেয়েদের সম্মেলনে এসে পড়েছেন কলা লাউরে।

‘‘আমরা বাল্মীক, কিন্তু আমার বাবার গুরু আমাদের গন্দা কাম করতে দেয়নি। আমার বাবা-মা, বাপের বাড়ির কাউকে কখনও কারও বাড়ি ময়লা সাফ করতে দেখিনি আমরা। কিন্তু গাঁয়ে ছুত-অচ্ছুত বহুত ছিল। আমার স্কুলে পড়ার খুব ইচ্ছে, বাবা যেতে দিত না। বলত, ওরা ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার করে। ভাইরা কিন্তু যেত। আমাকে পয়সা দিয়ে দোকানে এটা ওটা কিনতে পাঠাত বাড়ি থেকে। তার থেকে দু’চার পয়সা জমিয়ে আমি পট্টি কিনেছিলাম। পট্টি সমঝি? যিসকে উপর লিখতে হ্যায়। সিলেট? হাঁ হাঁ, ওহি। ভাইরা স্কুলে চলে গেলে ওদের জামা পরে, ওদের বই নিয়ে বসতাম, যেন পড়ছি। এগারোটায় স্কুল বসত। আমি করতাম কী, ক্লাসের বাইরে বসে থাকতাম। জানালা দিয়ে দেখতাম দিদিমণি বোর্ডে কী লিখছে। কাঠি দিয়ে ধুলোর উপর সেইগুলো লিখতাম। ম্যাডাম দেখতে পাবে মনে হলেই ঝুপ করে বসে পড়তাম। কিন্তু এক দিন অন্য বাচ্চারা বলে দিল, ম্যাডাম চুপি চুপি কখন এসে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে দেখতেই পাইনি। আমার হাতটা ধরে বলল, চুরি করে লেখাপড়া শিখছিস? বল তো, এটা কী? ওটা কী? আমি সব ঠিক বললাম। ম্যাডাম আমার বাড়ি গিয়ে বাবাকে বলল, ওকে স্কুলে দিচ্ছেন না কেন? বাবা মুখে বলল, দাখিল করা দেঙ্গে, কিন্তু নাম লেখাল না কিছুতেই। কিছু দিন স্কুল গিয়ে আমি ছেড়ে দিলাম।

তার পর তো বিয়েই হয়ে গেল আমার। তেরো বছর বয়সে। শাশুড়ি ঝুটা বলেছিল, আমার ছেলে হাসপাতালে কাজ করে। সত্যি কথা জানলাম শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পনেরো দিন পর। শাশুড়ি আমাকে নিয়ে একটা গাঁয়ে গেল, আমার হাতে টোকরি (ঝুড়ি) আর সাইকেলের মাডগাট (মাডগার্ড) ধরিয়ে দিল। বলল টাট্টি ঝাড়ার কাম করো। টাট্টি ঝাড়না সমঝতে হো? পা’খানা উঠানা টোকরি মে। আমি তো কিছুতেই করব না, ছুটে ঘরে চলে এলাম। সে দিন বর খুব মারল। বলল, তুমি কোন কালেক্টরের বেটি? ক’দিন মার খাবার পর বেরোতেই হল কাজে। গলা অবধি ঘোমটা, হাতে চপ্পল নিয়ে যেতে হত। বাল্মীক মেয়েদের গাঁয়ের মধ্যে চপ্পল পরা চলে না।

কুড়ি বছর এই কাজ করেছি। গ্রামের লোকে দু’লাখ, তিন লাখ টাকা দিয়ে বাড়ি বানাত, কিন্তু শৌচাগার রাখত না। আমাদের দিয়ে সাফ করাত। মাইনে দিত কেউ দু’টাকা, কেউ পাঁচ-দশ টাকা। বাড়িতে দশ-বারো জন থাকলে পনেরো টাকা দিত। একটা-দুটো বাসি রুটি দিত, তা-ও দূর থেকে ছুড়ে। আমাদের দেখলে লোকে দূর থেকে সরে যেত, জল নিতে গেলে দূরে দাঁড়াতে হত, আমাদের ঘড়ার সঙ্গেও যেন ছোঁয়া না লাগে। হ্যান্ডপাম্প করে আমরা জল তোলার পর ওরা মেজে নিত। দোকানে কোনও জিনিস ঝুড়ি থেকে তুলতে পারতাম না আমরা, আমাদের ছেলেমেয়েরা। দূর থেকে সবজি দেখিয়ে দিলে ওরা তুলে দিত। পয়সা দিলে ধুয়ে নিত। লোকের বাড়িতে গেলে নীচে বসতে হত, আমাদের বাচ্চাদেরও উপরে উঠতে দিত না। মন্দিরে গেলে আমাদের দেওয়া দই-চিনি পুরুত উঠিয়ে ভিতরে নিত, কিন্তু আমাদের উঠতে দেবে? বাপ রে। আমরা পা দিলে ওদের দেবতাও ভেগে যাবে মন্দির থেকে। মরেও রক্ষা নেই, ওদের শ্মশানে আমাদের পোড়াতে দেয় না। আমাদের শ্মশানটা খোলা, কোনও শেড নেই, যাওয়ার ভাল রাস্তাও নেই। বর্ষাকালে পোড়াতে গেলে ভিজে কাঠে পোড়ানো খুব কষ্ট।’’

এখানে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম, শুনলাম মন্দাসৌরে বর্ষার সময় এক জন দলিত মারা যেতে তাকে গাঁয়ের শ্মশানে পোড়াতে দেয়নি, তিন দিন বাড়িতে রেখে শেষে টায়ারের ওপর পোড়াতে হয়েছে? কলা লাউরে বললেন, ‘‘হ্যাঁ, এমন হয়। ওই জন্য বেশি করে কেরোসিন রেখে দিই।’’

কিন্তু আমাদের সন্তানেরা তো লজ্জায় মরে থাকে। এক দিন আমার মেয়ে তার স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছে, আর আমি ভরা টোকরি নিয়ে আসছি। একটা বন্ধু বলল, ওহ্ দেখ তেরি মাম্মি আ রহি হ্যায়। মেয়ে বলল, না না, ও আমার মাম্মি নয়। তার পর ছুট সেখান থেকে। বাড়ি এসে তার কী কান্না। তুম ইয়ে গন্দা কাম কিঁউ করতে হো? তখনও ভাবি, বুজুরগরা (বড়রা) এই কাজ করেছে, আমাদেরও করতেই হবে।

২০০২ সালে, যখন আমার বয়স প্রায় চল্লিশ তখন প্রথম কানে এল যে ইনসানের টাট্টি সাফ করা ইনসানের কাজ নয়। অনেক লোক এল আমাদের গাঁয়ে, শুনলাম তার নাম ‘গরিমা যাত্রা’। আমাদের বলল, তোমরা গোলামি ছাড়ো। ভাবলাম, কাজ ছাড়লে খাব কী? তিন-চার বার ওরা গ্রামে এসে কথা বলার পর এক দিন গ্রামের সাতটি বাল্মীক পরিবারের মেয়েদের এক করে একটা সভা করলাম। আমার স্বামীর কী রাগ। ‘ইয়ে লোগ ভড়কাকে চলে যায়েঙ্গে।’ গাঁয়ের লোক বলল, ‘ওরা যে কাজ ছাড়তে বলছে, ওরা কি খেতে দেবে?’

আমি কিন্তু ঠিক করে ফেললাম, মজদুরি করে খাব, ভিখ মেঙে খাব, এই গন্দা কাম আর করব না। সমুদায়কে মহিলাওঁ কো ভি সমঝায়া। ২০০৪ সালে ১৪ এপ্রিল বাবাসাহেবের জন্মদিনে আমরা সরপঞ্চের সামনে টোকরি, ঝাড়ু ফেলে আগুন ধরিয়ে দিলাম। সরপঞ্চ আমাদের কত বধাই দিল, সঙ্গে নিয়ে ফটো তোলাল।

ওমা, পর দিন আমার বাড়ি এসে বলল, আমার বাড়ির সামনে কে টাট্টি করে গিয়েছে, সাফ করে দাও। আমি বললাম, বাঃ, আপনার সামনেই এ কাজ ছাড়লাম। তা সরপঞ্চ বলে, সে তো কাল ছবি তোলা হয়ে গিয়েছে, আজ কাজটা করে দাও। আমি না হয় দশ টাকা দেব। আমি গলা উঁচু করে বলে দিলাম, তোমার বিবিকে বলো আমার ছেলের টাট্টি পরিষ্কার করে দিতে, আমি বিশ টাকা দেব। বহুত গালাগাল করে চলে গেল।

কিন্তু কে কাজ দেবে আমাকে? জোর করে অন্য মেয়েদের সঙ্গে সয়াবিনের খেতে গেলাম ফসল কাটতে। আমি কি আর মুঠো করে ফসল ধরে কাস্তে চালাতে শিখেছি? এই দেখো, এখনও আঙুলে কত বড় কাটার দাগ। না, সরকারের থেকে কোনও কাজ মেলেনি। একটা গ্রামে একটা বাল্মীক মেয়ে ছাগল পেয়েছিল, তা-ও মরে গিয়েছে। এই কাজ থেকে মুক্তি পেলে একটা অনুদান দেওয়ার কথা সরকারের। আমাদের রাজ্যের ছত্রিশটা গ্রামে তিনশো চারটে বাল্মীক মেয়েকে টাট্টি ঝাড়ার কাজ ছাড়িয়েছি আমি, ২০১৩ সালের মধ্যে। কেউ সে অনুদান পায়নি। তবে কেউ আর গন্দা কাজে ফিরে যায়নি। মজদুরি করে, আশা-র কাজ করে, দোকান করে। এখন গাঁয়ের লোক বাথরুম বানাচ্ছে। আমাদের বলে সাফ করতে। আমরা তা-ও করি না। বলে দিয়েছি, নিজের গন্দা নিজে সাফ করো। লেকিন ইস দেশ মে আভি ভি বারা লাখ লোগ টাট্টি ঝাড়নে কা কাম করতা হ্যায়। ঔরত হি জ়াদা। এদেরও কাজ ছাড়াব আমরা। এখন আর আমাদের কেউ মেথরানি বলতে সাহস করে না। ‘তুই’ বলতে পারে না।

এখন আমাদের লোকে বিয়েশাদি হলে ডাকে। আমাদের শাদিতেও গ্রামের লোকে আসে। আগে যারা ঘরে ঢুকতে দিত না, এখন তারা ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসায়। সে দিন এক জন বুড়ি বলল, কেন বসালে ওকে সোফায়? বাড়ির মেয়েরা বলল, ও তো এখন বড় বড় লোকেদের সঙ্গে ওঠাবসা করে। আমার বড় ছেলে ক্লাস টেন অবধি পড়েছে। বৌমা বারো ক্লাস অবধি পড়ে এসেছিল। এখানে বহুদের কেউ পড়ায় না, কিন্তু আমি দু’বছর কলেজে পড়িয়েছি। কম্পিউটারে ডিপ্লোমা পেয়েছে।

হ্যালোজেন আলোয় উদ্ভাসিত কলা লাউরের মুখ। শাশুড়ি যে বৌয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন টোকরি-ঝাড়ু, সে নিজের বৌমার হাতে দিয়েছে ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট। এ-ও একটা সাস-বহু সিরিয়াল, কিন্তু স্ক্রিপ্ট বিলকুল আলাদা।

Swiper Short Story

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}