নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্লাস্টিকের ব্যবহার।
আইন আছে। ফাইন (জরিমানা) আছে। কিন্তু বিবেক আছে কি?
যদি সেটাই থাকত তবে রোজ বিকেলে রাস্তা পেরিয়ে দু’টো ক্যারি প্যাকেট বোঝাই পুজোর ফুল প্রায় মজে আসা বেজিখালিতে ছুঁড়ে ফেলতেন না মাঝবয়সী ওই ভদ্রমহিলা। বেজিখালি হল কৃষ্ণনগরে অঞ্জনা নদীর আরেক নাম। শহরের প্রধান জলনিকাশের পথও এই নদীই। এক সময়ে কানায় কানায় জলে ভরে থাকা বেজিখাল এখন কাদা, পাঁকে ভরা নর্দমার রূপ নিয়েছে। বিগত দিনে কয়েক বার সংস্কার করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে পাঁকের নীচে শুধুই প্লাস্টিক।
একই অবস্থা কৃষ্ণনগর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা জলঙ্গি নদীরও। বর্তমানে জলঙ্গি নদী বাঁচানোর উদ্দেশ্যে শহরের বিভিন্ন পরিবেশপ্রেমী মানুষকে নিয়ে গড়ে উঠেছে নদী সমাজ। তাঁরা নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে সব সময়ে প্রচার করছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? পুজোর ফুল থেকে শ্রাদ্ধের উপকরণ প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগে ভর্তি করে রোজই ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে নদীতে। নদীর তলায় জমা হচ্ছে সেই সব প্লাস্টিকের বর্জ্য। মাছ বা অন্য জলজ প্রাণী সেই সব প্লাস্টিকের টুকরো খাবারের সঙ্গে খেয়ে ফেলছে। তাদের শরীর বয়ে ঘুর পথে সেই প্লাস্টিক আবার মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।
চিকিৎসকদের মতে, প্লাস্টিক থেকে হতে পারে ক্যানসারের মতো মারণ ব্যধিও। প্লাস্টিকে বুজে গিয়েছে শহরের প্রায় সব নিকাশি নালাই। সেগুলি দিয়ে এখন আর জল যেতে পারে না। নোংরা জল নর্দমা উপচে রাস্তা ভাসাচ্ছে নানা জায়গায়। বাড়ছে মশার উৎপাত। রাস্তার ধারের জঞ্জাল বা নর্দমায় পরে থাকা প্লাস্টিক বা থার্মোকলের পাত্রের জমা জলে জন্মাচ্ছে মশার লার্ভা। বাড়ছে মশা বাহিত নানান রোগের আশঙ্কা। একই ছবি জেলার অন্য শহরগুলিতেও। গ্রামের দিকের অবস্থা এখনও এতটা খারাপ না হলেও অনেক গবাদি পশুর মৃত্যু ঘটছে খাবারের সঙ্গে খেয়ে নেওয়া প্লাস্টিক পাকস্থলীতে জমে গিয়ে।
আসলে প্লাস্টিক ব্যাবহারের অভ্যাসের বিষ এখন আমাদের রক্তে মিশে গিয়েছে। ক’দিন আগেও কৃষ্ণনগরের প্রায় সব বাজারেই লঙ্কা থেকে মাংস সবই দেওয়া হচ্ছিল প্লাস্টিকের প্যাকেটেই। এমন অবস্থায় পরিবর্তনের উদ্দেশ্যেই ১৭ অক্টোবর থেকে কৃষ্ণনগর পুরসভা আইন করে প্লাস্টিকের ক্যারিবাগের ব্যবহারের উপরে জরিমানার ব্যবস্থা করেছে। শহরের যে দোকানে প্লাস্টিকের প্যাকেট, গ্লাস বা থার্মোকলের থালা-বাটি বিক্রি হবে সেই দোকানির ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করবে পুরসভা, এমনটাই জানান হয়েছে। এ ছাড়াও যাঁরা নতুন ট্রেড লাইসেন্স করতে আসবেন তাঁদেরও অঙ্গীকার করতে হবে, তাঁরা যেন প্লাস্টিকের কোনও প্যাকেট বা কন্টেনার ব্যবহার না করেন। তবেই মিলবে লাইসেন্স।
কৃষ্ণনগর পুরসভার প্রাক্তন পুরপ্রধান বর্তমানে পৌরসভার বোর্ড অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর-এর মেম্বার অসীম সাহা বলেন, ‘‘শহরের প্রায় প্রতিটা নিকাশি নালাই আজ প্লাস্টিকে অবরুদ্ধ। এই মুহূর্তে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আগামীতে সামান্য বৃষ্টিতেও ভেসে যেতে পারে শহর।’’
শান্তিপুরের পুরপ্রধান অজয় দে বলছেন, ‘‘প্লাস্টিকের ব্যাবহার কমানোর উদ্দেশ্যে শহরে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ বিলি করা হয়েছে। গত বছর গায়ক রূপম ইসলামকে এনে প্রচার চালান হয়েছে।’’ এমনকী, আগামীতে কৃষ্ণনগরের মতো জরিমানা চালু করার ভাবনাও শান্তিপুর পুরসভার রয়েছে বলে জানান পুরপ্রধান।
তবে, আইন বা নজরদারি যত যাই থাকুক না কেন, মানুষের বিবেক জাগ্রত না হলে কোনও ভাবে যে এই কর্মকাণ্ডে সাফল্য আসবে না— সে কথা মেনে নিচ্ছেন সকলেই। তাই কৃষ্ণনগরে গত ২ অক্টোবর বিভিন্ন বাজার এলাকা ঘুরে ১৭ তারিখ পর্যন্ত প্লাস্টিক ব্যাবহারের শেষ সীমা ঘোষণা করে দেওয়ার পরেও ১৮ তারিখ পাত্রবাজারে অভিযান চালালে বিভিন্ন দোকান থেকে প্রচুর প্লাস্টিক আর থার্মোকলের গ্লাস, থালা, বাটি বাজেয়াপ্ত হয়।
কবে আসবে সামগ্রিক সচেতনতা? একটা ব্যাগ নিয়ে বাজারে গেলে যেখানে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, সেখানে খালি হাতে বাজার গিয়ে দোকানিকে প্লাস্টিকের প্যাকেট দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে নাগরিকের। খোঁজ নিয়ে বোঝা গেল বেশির ভাগ দোকানির প্লাস্টিক বন্ধের সদিচ্ছা আছে। কিন্তু ক্রেতার নেই। এখনও দোকানি প্যাকেট দিতে অস্বীকার করলে ক্রেতা রাগ দেখিয়ে অন্য দোকানে চলে যাচ্ছেন। মাছ-মাংসের জন্য ব্যাগ থাকলেও একটা ক্যারি প্যাকেটে ভরে তার পর সেই মাছ- মাংস ব্যাগে পুরছেন তাঁরা। কেউ কেউ তো আবার খেপেও উঠছেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে। প্যাকেট বন্ধের কথা শুনেই চিৎকার করে বলছেন, ‘‘আগে প্লাস্টিকের কারখানা বন্ধ করুন!’’ তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয়— প্লাস্টিক প্যাকেটের উৎপাদন বন্ধ হয়নি, তা হলেও কি প্লাস্টিক ব্যবহার করতেই হবে? আর চাহিদা বন্ধ হলে যে প্লাস্টিকের প্যাকেটের জোগানও বন্ধ হবে, সেটা কেন একবারও ভাবছেন না নাগরিক?
আশার কথা, কৃষ্ণনগরকে প্লাস্টিকমুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে পরিবেশ সচেতন অনেকে একত্রিত হয়েছেন। ‘পরিবেশ বন্ধু’ নামে এক সংগঠন তৈরি করে গত প্রায় দেড় বছর ধরে প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালাচ্ছেন তাঁরা। ওই সংগঠনটিও বর্তমানে যুক্ত হয়েছে প্রশাসনের সঙ্গে, প্লাস্টিকমুক্ত শহর গড়ে তোলার যাবতীয় কর্মকাণ্ডে। ‘পরিবেশ বন্ধু’র সভাপতি ইলা বিশ্বাস প্লাস্টিক মুক্ত আন্দোলন নিয়ে বলেন, ‘‘এখন মানুষ অনেক বেশি সচেতন। সব কিছুর সঙ্গেই এখন জড়িয়ে আছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। তাই সময় লাগবে। আগামীতে আমাদের লড়াই হবে পরিবেশ-বান্ধব প্রচার নিয়ে। বর্তমানে যে ফ্লেক্স ব্যবহার হচ্ছে, তা পরিবেশের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর।’’
প্রত্যাশা এখন একটাই— পুরোপুরি প্লাস্টিকমুক্ত হোক শহর। দূষণমুক্ত হোক নদী। এক বুক কাচের মতো জল নিয়ে আগের মতো ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বয়ে চলুক জলঙ্গি, অঞ্জনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy