কাজ অনেক, তাই স্বাস্থ্য দফতর নিজের হাতে রাখতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকে কথাটি জানিয়েছেন। একই যুক্তির ভিত্তিতে পৌঁছনো যেত বিপরীত সিদ্ধান্তে— দায়িত্ব গুরুতর, সঙ্কট তীব্র, এই কারণেই কেবল স্বাস্থ্য দফতরের জন্য এক জন পূর্ণ মন্ত্রী প্রয়োজন ছিল। প্রশাসনের রীতি এবং নীতি সে কথাই বলে। চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য, মেডিক্যাল শিক্ষা ছাড়াও নানা দফতরের সঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরের সদা-সমন্বয় এক বিপুল কর্মকাণ্ড। সর্বোপরি, সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থার প্রতিকার, সরকারি চিকিৎসকদের উপর মানুষের ভরসা ফেরানো প্রয়োজন। আর জি কর কাণ্ড থেকে শুরু করে মেদিনীপুরে দূষিত স্যালাইন কাণ্ড, প্রতি কেলেঙ্কারিই স্বাস্থ্য দফতরের ব্যর্থতার প্রমাণ। কর্তব্যরত মহিলা-চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুন, কিংবা হাসপাতালে প্রসূতির মৃত্যু, কোনওটিই অকস্মাৎ ঘটেনি। তৃণমূলের শাসনকালে মেডিক্যাল কলেজের পরীক্ষার নম্বর, হাসপাতালের শয্যা, ওষুধ-স্যালাইন, মেডিক্যাল বর্জ্য নিয়ে অবৈধ লেনদেন সীমা ছাড়িয়েছে। ‘হুমকি সংস্কৃতি’ সরকারি হাসপাতালে কর্মসংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে। নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে রাজনীতির প্রশ্রয়প্রাপ্ত কিছু দুর্বিনীত প্রশাসকের যথেচ্ছ দুরাচার যেন ‘নিয়ম’ হয়ে উঠেছে। প্রসূতি-মৃত্যুর হার, ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রামক অসুখে মৃত্যুর হারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান হতাশাজনক। স্বাস্থ্যের এই অব্যবস্থার অবসানের জোরালো দাবি উঠেছিল চিকিৎসক সমাজের ভিতর থেকেই, উঠেছিল নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও। গণতন্ত্রে শাসকের নৈতিক দায়বদ্ধতার নিরিখে স্বাস্থ্যমন্ত্রীরই সেই দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল।
অথচ সেই সময়োচিত দাবির সামনে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অ-পরিবর্তনেই অটল রইলেন। স্বাস্থ্য সচিবের পদত্যাগের দাবি খারিজ হল, হুমকি সংস্কৃতি অবসানের পরিবর্তে ভীতিপ্রদর্শনে অভিযুক্তরা কলেজে ফিরল, দুর্নীতির দায়ে নিলম্বিত চিকিৎসকরা মেডিক্যাল কাউন্সিলে ফিরলেন, রোগী কল্যাণ সমিতি ভেঙে দেওয়া হল। দূষিত স্যালাইন কাণ্ডের পর চিকিৎসক-নার্সদের উপরেই দায় চাপানোর চেষ্টা হল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর এই অ-পরিবর্তনের রাজনীতির দু’টি দিক রয়েছে। একটি হল, নাগরিকের কাছে যা সঙ্কট, রাজনীতিতে তাকে লঘু, তুচ্ছ, ভ্রান্ত বলে দেখানো। রোগী এবং চিকিৎসক, দু’তরফেরই নিরাপত্তা ও মর্যাদার জন্য জুনিয়র ও সিনিয়র ডাক্তাররা সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে সংস্কার দাবি করেছিলেন, তা স্বীকার করলে তার জন্য প্রশাসনে বড় মাপের পরিবর্তন আনতে হত। তাতে ক্ষমতার ভারসাম্য বদল হত, ক্ষমতাসীনের কাছে যা মস্ত ঝুঁকি। তাই যে কোনও প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে বার বার মমতা প্রশ্ন করেন, তাঁকে জানানো হয়নি কেন? অর্থাৎ প্রশাসনিক ‘ব্যবস্থা’র যে ক্ষমতা নেই, তা ব্যক্তি হিসাবে তাঁর আছে। গণতান্ত্রিক প্রশাসন এই ভাবে চলার কথা ছিল না, তা কখনওই বাঞ্ছনীয় নয়।
তা ছাড়া, তিনি সত্যিই পারেন কি, স্বচ্ছ, দক্ষ, সংবেদনশীল প্রশাসন তৈরি করতে? চিকিৎসকদের বেতন বাড়াতে রাজকোষের যে টাকা তিনি বরাদ্দ করলেন, সমতুল্য অর্থে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক, থানায় বাড়তি পুলিশ, উন্নত ফরেন্সিক ল্যাব তৈরি করা যেত, যা কর্মরত মেয়েদের নিরাপত্তা দিত এবং বিচারব্যবস্থাকে উন্নত করত। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী সে কথা ভাবলেন না, কারণ অ-পরিবর্তনের রাজনীতির দ্বিতীয় নিয়ম হল নাগরিকের ব্যক্ত চাহিদা অগ্রাহ্য করে, নিজের রাজনৈতিক সুবিধামতো চাহিদার নির্মাণ। নেতা যা দিতে পারে, তা-ই নাগরিকের ‘আসল’ চাহিদা, এ-হেন ইন্দ্রজাল নির্মাণ। সেই অদ্ভুত মায়াজগতে নাগরিক ‘ন্যায়, নিরাপত্তা, মর্যাদা’ উচ্চারণ করলে প্রতিধ্বনি ফিরে আসে ‘টাকা, টাকা, টাকা’। সুতরাং, বিচার এবং সংস্কারের বদলে বেতন বৃদ্ধি। টাক ডুমাডুম।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)