সতেরো মাস পূর্ণ হল, মণিপুর এখনও জ্বলন্ত। কেবল জ্বলন্ত নয়, সংঘর্ষ সে রাজ্যে আরও অনেক ধাপ বেড়ে গিয়েছে গত সপ্তাহ জুড়ে। মেইতেই ও কুকি-জ়ো গোষ্ঠীর মধ্যে ভয়ঙ্কর হিংসায় সতেরো মাসে একশোরও বেশি মানুষ নিহত, উৎপাটিত উচ্ছিন্ন আহত সর্বস্বান্ত মানুষের সংখ্যা অগণন, লক্ষাধিক, শয়ে শয়ে বাড়ি অগ্নিদগ্ধ। উত্তর-পূর্বের এই ছোট পার্বত্য রাজ্যে জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যাগুলির অর্থই আলাদা। অথচ ভারতের অন্যত্র এই সতেরো মাস ধরে রাজনীতি ভোটনীতি বিবাদ বিতণ্ডা জনরোষ অসন্তোষ ইত্যাদির মধ্যে মণিপুরের নাম শোনা গিয়েছে কতখানি? প্রশ্নটি বিবেকবান ভারতীয় নাগরিক নিজেকেই ফিরে করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কাউকে মণিপুর নিয়ে বিশেষ মুখ খুলতে শোনা যায়নি, যায় না— কেবল এক আক্রান্ত মহিলাকে ঘিরে ভয়ঙ্কর একটি ভিডিয়ো যখন প্রকাশিত হয়েছিল, সেই সময়টুকু ছাড়া। সেই সময়ে সুপ্রিম কোর্টেও বিষয়টি উঠেছিল, কিন্তু আদালতের চত্বরে আলোচনা শেষ হতেই আবার সব জনবিস্মৃতির অতলে তলিয়েছে। এই দায়হীনতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কেবল রাজনৈতিক নেতাদের বিষয় বললে ঠিক হবে না। বিশেষ লক্ষণীয়, রাষ্ট্রের শাসক দল বা শীর্ষ পদাধিকারীদের তেমন ভাবে উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করেনি নাগরিক সমাজও। দেশ জুড়ে এই প্রশ্ন ধ্বনিত হয়ে ওঠেনি যে এমন লাগাতার নৃশংসতার পরেও রাজনৈতিক প্রধানরা কেন এমন নির্বিকার নিরুত্তাপ, ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। সংসদের অধিবেশনে তর্কাতর্কির মধ্যে মণিপুরের কথা শোনা গেলেও তা নিয়ে সংসদের বাইরে কোনও চাপ দেখা যায়নি। বললে ভুল হবে না, প্যালেস্তাইন নিয়ে ভারতীয় নাগরিক সমাজে যতটুকু হৃদয়বেদনা দেখা গিয়েছে, মণিপুর এমনকি সেটুকুও জাগাতে পারেনি। উত্তর-পূর্ব ভারতীয় সমাজের মধ্যে একটি গভীরপ্রোথিত তীব্র ক্ষোভ আছে যে সর্বার্থে তাঁদের ভারতীয় সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। আজ এই অভিযোগকে বর্ণে-বর্ণে সত্য বলে স্বীকার করতে হবে— মণিপুর ঘটনার প্রতিক্রিয়া, অথবা প্রতিক্রিয়ার আত্যন্তিক অভাব তা প্রমাণ করে দিয়েছে।
বাস্তব হল, সংরক্ষণ প্রশ্নে সংঘাত শুরু হওয়ার পর সতেরো মাস ধরেই কিন্তু ভারতের মূলস্রোতের কাছে মণিপুরের নাগরিক সমাজ আপ্রাণ আর্তি জানিয়ে আসছে। তাঁদের বাসস্থান সংস্থান স্বাভাবিক জীবন সব শেষ হয়ে যাওয়ার জোগাড়, একের পর এক হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা ট্রমা তৈরি করেছে একটি গোটা জনসমাজে, সাংবাদিকদের উপর অবিরত গুলি চলছে কেননা তাঁরা এ সব সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, পুলিশ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অবিরত সংঘর্ষ ভয়াল আকার ধারণ করেছে, সন্ত্রাসী হানা চলেছে দুই যুযুধান জনগোষ্ঠীর মধ্যে, ইন্টারনেট ব্রডব্যান্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মণিপুরের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ মিছিল করছেন, সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে সহায়তা ভিক্ষা করছেন, একের পর এক নারী-বিক্ষোভ ঘটে গিয়েছে। বৃহত্তর ভারত থেকে কোনও সাড়া পাননি তাঁরা।
যে স্বল্পসংখ্যক ভারতীয়ের কাছে মণিপুরের প্রাসঙ্গিকতা আছে, তাঁরা অবশ্য সন্ত্রস্ত হয়ে দেখছেন, ড্রোন দিয়ে বোমা ফেলে আক্রমণ শাণিয়ে আর এক ধাপ উপরে উঠেছে সংঘর্ষের চেহারা। অনেকে হতাহত হয়েছেন কুকি-জ়ো পক্ষ থেকে এই নতুন ধারার আক্রমণে। আক্রমণকারীরা জানিয়েছেন, তাঁদের উপর নৃশংসতার বদলা নিতেই ড্রোনবোমার পথ বেছেছেন তাঁরা। সরকার অপরাধীদের ধরতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে, কিন্তু তা যে যথেষ্ট নয় সে কথা পুলিশ ও প্রশাসন উভয়েই বিশেষ অবগত। কেন তবু আরও দক্ষ বাহিনীকে দিয়ে সন্ত্রাস বন্ধ করা হচ্ছে না, সে প্রশ্ন তোলা জরুরি। সন্ত্রাস ঠেকানোর কড়া পদক্ষেপ চাই, চাই রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের যুগপৎ মূল সমস্যার সমাধানের নতুন প্রয়াস। মূলে গিয়ে সঙ্কটের সুরাহা না করলে মণিপুরের আগুন নেবানো যাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy