রাজনীতিতে ধর্ম এসে মিশলে কী হয়, ভারত জানে। এ বছরের কুম্ভমেলা বোঝাল, ধর্মে রাজনীতি মিশলে তার ফলও আক্ষরিক অর্থেই মারাত্মক। সরকারি হিসাবেই কুম্ভমেলায় পদপৃষ্ট হয়ে প্রাণ গেল অন্তত ৩০ জনের। শুধু সেই এক দিনের ঘটনা নয়, দেড় মাস ব্যাপী মেলার কার্যত প্রতিটি দিনই সাধারণ তীর্থযাত্রীদের জন্য কোনও না কোনও বিপদ তৈরি করল— কখনও বড় মাপের, কখনও খুচরো; কখনও সেই বিপদের ফল তৎক্ষণাৎ টের পাওয়া গেল, আবার কখনও স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার বীজ বপণ করল সেই বিপদ। এ কথা অনস্বীকার্য যে, কুম্ভে পদপৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা আগেও ঘটেছে; গঙ্গার জলও হঠাৎ এ বছরই এমন বিষিয়ে ওঠেনি; সাধারণ তীর্থযাত্রীদের থাকা-খাওয়া-স্নানের সমস্যাও নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু, এ বছর যা আলাদা, তা হল কুম্ভের রাজনৈতিক ব্যবহার। ২০২৭-এ উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির মাত্র ৩৩টি আসন জয় আদিত্যনাথের নির্বাচনী প্রতিভা সম্বন্ধে বিবিধ প্রশ্ন তৈরি করেছিল। বিধানসভা নির্বাচনে যাতে সেই প্রশ্নের ছায়ামাত্র না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে আদিত্যনাথ বেছে নিয়েছেন কুম্ভমেলার পরিসরটিকেই। তা ছাড়া, পরবর্তী হিন্দু হৃদয়সম্রাটের মুকুটটি অর্জনের অভিলাষ থাকলে হিন্দুধর্মের বৃহত্তম জনসমাগমটির চেয়ে উপযুক্ততর উপলক্ষ আর হয় কি?
তারকা-সন্নিবেশও সমধিক সহায়ক। এ বছরই মোদী জমানার প্রথম পূর্ণকুম্ভ। ফলে জনসমাগমে যাতে কোনও ঘাটতি না থাকে, তা নিশ্চিত করতে সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়েছিল গোটা দক্ষিণপন্থী বাস্তুতন্ত্র। জানা গিয়েছিল, এই কুম্ভে মোট তীর্থযাত্রীর সংখ্যা পৌঁছে যাবে পঁয়তাল্লিশ কোটিতে। সংখ্যাটি নাকি আরও অনেক বেড়ে গিয়েছে, সরকারি দাবি। রেকর্ড-ভাঙা ভিড় তৈরির চেষ্টায় কোনও খামতি থাকেনি। অন্য দিকে, বিজেপি এই পরিসরটিকেই বেছে নিয়েছিল তথাকথিত নিম্নবর্ণের ভোটব্যাঙ্কের ভাঙন মেরামত করার কাজে। রামচন্দ্রের সঙ্গে নিষাদরাজের ছবি দিয়ে পোস্টার তৈরি করল উত্তরপ্রদেশ সরকার; আদিত্যনাথ প্রয়াগরাজে উদ্বোধন করলেন নিষাদরাজ পার্কের, বললেন, ‘কুম্ভমেলা হল সমতার মহাপার্বণ’; প্রধানমন্ত্রী মোদী জানালেন যে, ‘কুম্ভ আসলে ঐক্যের মহাযজ্ঞ’। খেয়াল রাখা ভাল যে, রাজনৈতিক ভাবে যাঁদের কাছে টানার জন্য এত কথার মালা গাঁথা, এত ফুলের শয়ন পাতা, আর্থ-সামাজিক মাপকাঠিতে তাঁরা নিতান্তই পিছিয়ে পড়া মানুষ। এমন জনগোষ্ঠী, কুম্ভের পরিসরে যাঁরা সম্পূর্ণ ভাবে সরকারের বদান্যতার উপরে নির্ভরশীল। এক অর্থে বিজেপির রাজনৈতিক প্রচার তাঁদের মেলায় আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিল। উত্তরপ্রদেশ সরকার তাঁদের জন্য সুব্যবস্থা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এই কারণেই মেলার রাজনৈতিক ব্যবহারজনিত অব্যবস্থার দায় রাজ্য সরকারের উপরে বর্তাবে। এখানেই এই বছরের মেলা অন্য সব কুম্ভমেলার চেয়ে পৃথক।
বারে বারেই অভিযোগ উঠেছে মেলার ভিআইপি-সংস্কৃতি বিষয়ে। অভিযোগ, আর্থিক ও সামাজিক ভাবে ক্ষমতাবানদের জন্য যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সরকার সাধারণ মানুষের দিকে তাকানোর অবকাশ পায়নি। কুম্ভমেলার মতো পরিসরেও যে, সব নাগরিক সমান নন, ভারতীয় গণতন্ত্র এ কথা হাড়ে হাড়ে জানে। ভিআইপি-দের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিলই। তবে এত দিন অবধি জানা ছিল, কুম্ভমেলার পরিসরে পুলিশ-প্রশাসন সাধারণ মানুষের কথা দরদ দিয়েই ভাবে, তাদের যথাসাধ্য সুবিধাদানের চেষ্টা করে। আদিত্যনাথের কুম্ভ সেই বিশ্বাসটিও ভেঙে দিল। মেলার শেষ লগ্নে প্রধানমন্ত্রী সমালোচকদের মনোভাবকে ‘দাস মানসিকতা’ বলে দেগে দিয়ে বোঝালেন, রাজনীতি অব্যাহতই থেকেছে। মেলা থেকে তাঁদের রাজনৈতিক লাভ কতখানি, সে প্রশ্নের উত্তর সময় দেবে— কিন্তু, ভোটের সময় ছাড়া রাজনীতির চোখে সাধারণ মানুষ যে মূল্যহীন, তা আবার প্রমাণিত হল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)