আদালতের কিছু কিছু রায় ঐতিহাসিক বলিয়া স্বীকৃত ও বন্দিত হয়। যেমন ডাক্তারি পড়িবার যোগ্যতা নির্ণায়ক সর্বভারতীয় ‘নিট’ (এনইইটি) পরীক্ষার ক্ষেত্রে সংরক্ষণের প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের প্রদত্ত সাম্প্রতিক রায়টি। যে সুষ্ঠু, সুশৃঙ্খল এবং গভীর যুক্তি দিয়া বিচারপতিরা এই রায়কে প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন, তাহা কেবল আদালতের ক্ষেত্রে নহে, সামাজিক প্রতর্কের বৃহত্তর পরিসরেও দিকনির্দেশক হইয়া থাকিবে। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) জন্য চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ সংরক্ষণ করিলে যোগ্যতার (মেরিট) দাবি অস্বীকার করা হয় কি না, এই বিতর্কের নিষ্পত্তি করিতে গিয়া আদালত বলিয়াছে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা যোগ্যতার ফলাফলকে যোগ্যতার সমার্থক বলিয়া গণ্য করা চলে না; সেখানে পরীক্ষার্থীরা এক অর্থে সমান সুযোগ পান বটে, কিন্তু সেই সমতা কেবলমাত্র বহিরঙ্গের (ফর্মাল)। অর্থাৎ, দুই জন পরীক্ষার্থী সমান ফল করিলেই সেই সমতাকে তাঁহাদের সমান যোগ্যতার নিঃসংশয় প্রমাণ বলা চলে না। যথার্থ সমতা অনেক সময়েই আপাত-সমতা হইতে দূরবর্তী। সংরক্ষণ এই দূরত্ব কমাইবার একটি সম্ভাব্য প্রকরণ।
এই দূরত্বের কারণ কী? সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যের মর্মার্থ: প্রতিযোগিতার পরীক্ষায় কে কেমন ফল করিতেছে, তাহা যোগ্যতার একটি আংশিক পরিচয় বহন করিতে পারে— ব্যক্তির উৎকর্ষ, সক্ষমতা এবং সম্ভাবনা পরীক্ষার ফলাফলে যথেষ্ট প্রতিফলিত হয় না, কারণ সেই সামগ্রিক যোগ্যতাকে রূপ দেয় পরীক্ষার্থীর ‘জীবনের অভিজ্ঞতা, পরবর্তী প্রশিক্ষণ এবং ব্যক্তিগত চরিত্র’। লক্ষণীয়, ‘জীবনের অভিজ্ঞতা’কে যোগ্যতার অন্যতম নির্ণায়ক হিসাবে নির্দিষ্ট করিবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিকে সমাজের অংশ হিসাবে চিনিবার পথটি উন্মুক্ত হয়। বিচারপতিরা এই সূত্রেই বলিয়াছেন, ‘যোগ্যতাকে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখা দরকার এবং যোগ্যতার ধারণাকে এমন একটি প্রকরণ হিসাবে নির্মাণ করা দরকার যাহা সমতার ন্যায় সামাজিক গুণের প্রসার ঘটায়, যে গুণকে আমরা সামাজিক ভাবে মর্যাদা দিই’। অতঃপর তাঁহাদের মূল্যবান মন্তব্য: “এই পরিপ্রেক্ষিতে, সংরক্ষণ যোগ্যতার পরিপন্থী নহে, বরং তাহা সমতার (সামাজিক) বণ্টনকে আরও বিস্তৃত করে।” অর্থাৎ, সমাজের বৈষম্য-বঞ্চনার জন্য যাঁহারা বহু যুগ ধরিয়া পশ্চাৎপদ, ‘সকলের জন্য এক পরীক্ষা’র দ্বারা তাঁহাদের যোগ্যতা নির্ণয় করিলে যথার্থ সমতার শর্ত পূর্ণ হইতে পারে না, তাঁহাদের সমতার স্বার্থেই বিশেষ সুবিধা দেওয়া দরকার। সংরক্ষণ সেই বিশেষ সুবিধা: সুদীর্ঘ সামাজিক বৈষম্যের প্রতিষেধক।
সংরক্ষণের গভীর তাৎপর্য ও যৌক্তিকতা নূতন ভাবে প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে অভিবাদন জানাইবার পরে, তাহার সিদ্ধান্তের সূত্র ধরিয়াই, একটি সংযোজন আবশ্যক। সামাজিক অবিচারের প্রতিষেধক হিসাবে সংরক্ষণের প্রকরণটিকে যেন অনন্ত কাল ব্যবহার করিয়া চলিতে না হয়, কারণ তাহা হইলে কার্যত সেই অবিচারকেই স্বাভাবিক বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। বিশেষ সুযোগের সার্থকতা তখনই, যখন বিশেষ সুযোগকে যত শীঘ্র সম্ভব অপ্রয়োজনীয় করিয়া দেওয়া যায়। তাহার অন্যতম প্রধান উপায় শিক্ষার বনিয়াদি স্তরে সমস্ত সামাজিক বর্গের সুষম বিকাশ। তাহার জন্য সেই স্তরে আরও বেশি কিছু কাল সংরক্ষণ হয়তো অপরিহার্য। কিন্তু বনিয়াদি শিক্ষায় যথার্থ সমতা প্রতিষ্ঠিত হইলে উচ্চশিক্ষার পর্বে বিশেষ সুযোগের প্রয়োজন ক্রমশ কমিয়া আসিবে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ভারতে আজও তাহা ঘটে নাই। এই বিষয়ে নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সংরক্ষণকে নির্বাচনী রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করিবার ব্যাপক প্রবণতা না ঘুচিলে অবশ্য সেই জরুরি কাজ সম্পন্ন হইবার আশা সুদূরপরাহত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy