আজ হইতে একশো এগারো বৎসর পূর্বে ইউরোপে আয়োজিত নারী সম্মেলনে মহিলাদের সমানাধিকার ও ভোটাধিকারের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইয়াছিল। গঙ্গা যমুনা টেমস দিয়া বহু জল গড়াইয়াছে, ভোটদানের অধিকার পার করিয়া নারীরা আজ ভোট গ্রহণের কর্মীও বটে, তবু সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করিবার লড়াই কি শেষ হইয়াছে? আজও মহিলাদের কর্মস্থলে পৌঁছাইতে বহু বেড়া ডিঙাইতে হয়। যথা, পশ্চিম মেদিনীপুরের বহু মহিলা ভোটকর্মী জানাইয়াছিলেন যে, পাঁচ বৎসরের কম বয়সি সন্তানকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘরে ফেলিয়া আসিয়া দায়িত্ব পালন করা সহজ নহে, ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব। আপাতত সেই সমস্যার সুরাহা করিয়াছেন এক মহিলা জেলাশাসক, বুথের পার্শ্বে একটি নির্দিষ্ট ঘরে সন্তানকে রাখিবার বন্দোবস্ত থাকিবে, দেখভালের জন্য এক পরিজনও থাকিতে পারিবেন। জেলাশাসক ধন্যবাদার্হ। তাঁহার কর্মীদের সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা ও পরিষেবা পৌঁছাইয়া দিবার জন্য। মানবাধিকারের দিকে লক্ষ রাখিবার জন্য।
হায়, বিষয়টি যে মানবাধিকারের, ইহা এখনও ভারতীয় সমাজের বৃহদংশ বুঝিয়াই উঠিতে পারে নাই! স্মরণে আসিবে, দুই বৎসর পূর্বে সাউথ সিটি মলের ভিতর কোলের সন্তানকে স্তন্যপান করাইতে গিয়া চরম অপদস্থ হইয়াছিলেন এক তরুণী। কর্মীরা তাঁহাকে নিষেধ করিয়াই ক্ষান্ত দেন নাই, শৌচাগারে গিয়া স্তন্যপান করাইবার পরামর্শও দিয়াছিলেন। মল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উপদেশ আসিয়াছিল, স্তন্যপান করাইয়াই কেনাকাটায় বাহির হওয়া উচিত। প্রশ্ন এখানে দুইটি। প্রথমত, বৃহৎ বিপণির দায়িত্বশীল কর্মী-বর্গ কী করিয়া কাহাকেও নির্দ্বিধায় শৌচাগারে স্তন্যপান করাইবার ন্যায় অস্বাস্থ্যকর পরামর্শ দিতে পারেন? এমতাবস্থায় কি ইহাই প্রমাণ হয় না যে, মায়ের স্তন্যপানে শিশুর বাড়িয়া উঠিবার সহজ সত্যটি শরীরী আকর্ষণের মায়ায় আচ্ছন্ন করিয়া রাখিতেছে পুরুষতন্ত্র? দ্বিতীয়ত, গণপরিসরে স্তন্যপানের জন্য আলাদা স্থান নাই কেন? উহাকে কি তাদৃশ জরুরি বলিয়া মনে করে না এই ব্যবস্থা? পথে বাহির হইলে তাই নারীকে স্বাভাবিক অধিকারগুলি অর্জন করিতে করিতে চলিতে হয়। সংগ্রামের পথে।
অধিকারের বিতর্ক উঠিয়াছে নানা দেশের আইনসভাতেও। ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে ‘পরিবারবান্ধব’ করিয়া তুলিবার দাবি বহু দিনের, তাহাতে নারীর অধিকার সুরক্ষিত থাকিবার সুযোগ বাড়ে। সদ্যোজাত সন্তানের সহিত দীর্ঘ সময়ের বিচ্ছিন্নতা মায়ের পক্ষে অসম্ভব, সন্তানের পক্ষেও। সন্তানকে সঙ্গে রাখিবার ও স্তন্যপান করাইবার যথাযথ সুযোগ থাকিলে কর্মস্থলে নারীর বিপুল বাধা কিঞ্চিৎ লাঘব হয়। এই প্রসঙ্গে সদর্থক সিদ্ধান্তের সাক্ষী নিউ জ়িল্যান্ডের আইনসভাও। বস্তুত, মায়ের অধিকার মৌলিক মানবাধিকারের সম্প্রসারণমাত্র। নারীরা সমাজে দায়িত্ব গ্রহণ করিবার সুযোগ পাইলে সেই সকল অধিকারও পাওয়া আবশ্যক। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে পালনীয় ভূমিকা লইয়াই এক জন সমগ্র মানুষ গড়িয়া উঠে। কোনও অংশকে বাদ দিয়া দিলে তাহাকে অস্বীকার হয় না, তাহার কাজে বিঘ্ন ঘটানো হয়। আমাদের দেশের কর্মক্ষেত্র এই রূপ বহু বিঘ্নে জর্জরিত। অতএব, একটিমাত্র জেলার টুকরা সংবাদও উদ্যাপনের কারণ হইয়া উঠে। উহাও প্রগতির পথে হাঁটিবার এক খণ্ড উজ্জ্বল নিদর্শন হইয়া থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy