—প্রতীকী ছবি।
পশ্চিমবঙ্গে নিয়োগ দুর্নীতি মহাপর্ব একটি বিরাট মাইলফলকে পৌঁছল। বহু বাঁক ঘুরে বহু শুনানি শুনে এসে কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে বাতিল হল ২০১৬ সালের প্রক্রিয়ায় হওয়া সমস্ত নিয়োগ— যে সংখ্যাটি ইতিমধ্যে বহু-আলোচিত— ২৫৭৫৩। এর আগে মামলা চলাকালীন এমন একটি সম্ভাবনার কথা শোনা গিয়েছিল বটে যে কেবল দুর্নীতি-প্রসূত নিয়োগ নয়, এক ধাক্কায় সব নিয়োগ বাতিল হতে পারে। কিন্তু শেষ অবধি সেটাই বাস্তব হবে, এমন কথা আন্দোলনকারীরাও ভেবেছিলেন কি না সন্দেহ। আদালতের এই রায়ে এসএসসি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং তৎসূত্রে সামগ্রিক রাজ্য সরকারের প্রতি যে প্রবল অনাস্থা ধ্বনিত হল, তৃণমূল কংগ্রেস শাসনের ত্রয়োদশ বর্ষের শাসনপর্বে, এবং পশ্চিমবঙ্গের সাতাত্তর বছরের জীবনে, তা ঐতিহাসিক। প্রশাসনের কান্ডারিরা কি বুঝতে পারছেন, তাঁরা কত বড় নৈরাজ্য ও দুর্নীতির ইতিহাস তৈরি করে দিয়ে গেলেন? অভিযোগ উঠে আসা সত্ত্বেও, আদালতে একাদিক্রমে মামলা আসা সত্ত্বেও, বিচারপতিদের উপর্যুপরি ভর্ৎসনা সত্ত্বেও প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা হয়নি, বরং অভিযুক্তদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, ‘ব্যবস্থা’টিকে অক্ষত রেখে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণে শিক্ষক নিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে দুর্নীতিবিষে জর্জরিত করে দেওয়া হয়েছে। একাধারে দু’টি বিপদ ঘনিয়ে তোলা হয়েছে, এক, চাকরি নিয়োগের ক্ষেত্রে, দুই, যোগ্যতার বিচার ব্যতীত নিয়োগ ঘটিয়ে বিদ্যালয়শিক্ষায় সর্বনাশ আনার ক্ষেত্রে। এ রাজ্যের স্কুলে শিক্ষকসংখ্যা এমনিতেই কম, আজ এই চাকরি বাতিলের ধাক্কায় তা আরও কমে গেলে স্কুলগুলি চলবে কী করে?— এই বিরাট প্রশ্নচিহ্নটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজহস্তে নির্মিত, নিজযত্নে লালিত ও পালিত। এর জবাবের দায়ও সরকারেরই।
আদালতের রায় প্রকাশে স্বভাবতই বড় জয় দেখছেন রাজ্যের বিরোধী পক্ষ— বিশেষত ভোটের মধ্যে এমন ঘটনায় তাঁদের উৎফুল্লতার সীমা নেই। উৎফুল্ল বিরোধী নেতা আগে থেকেই বাণী বিতরণ করছিলেন দেখে কেউ অনুমান করতে পারেন, রায়ের চরিত্র অপ্রত্যাশিত ছিল না তাঁদের কাছে। রায় শুনে মুখ্যমন্ত্রীও সপাটে জানিয়েছেন, তাঁর সরকার দ্রুত উচ্চতর আদালতে যাবে বিচারের জন্য। রাজনীতির চাপান-উতোরের ঊর্ধ্বে উঠে দেখলে অবশ্য কয়েকটি বিষয় গভীর উদ্বেগজনক। প্রথমত, কেবল অন্যায্য নিয়োগগুলির মীমাংসা না করে সমগ্র নিয়োগ বাতিল করা কি যোগ্য নিযুক্তদের প্রতি অবিচার নয়? দ্বিতীয়ত, যাঁরা প্যানেলে প্রতীক্ষারত, তাঁদের পরিস্থিতি স্পষ্ট নয় বলেও শঙ্কার কারণ নেই কি? তৃতীয়ত, বেআইনি ভাবে নিযুক্তদের চার সপ্তাহের মধ্যে সমস্ত প্রাপ্য অর্থ ফেরত দিতে হবে, সঙ্গে ১২ শতাংশ বার্ষিক সুদও দিতে হবে, এই চাপ কি অতিরিক্ত নয়? বেআইনি প্রথায় যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁরাই তো একা অপরাধী, শাস্তিযোগ্য নন— যাঁরা এই প্রথা তৈরি করেছেন, তাঁরা তো মেঘের আড়ালেই রইলেন? মানবিকতার বিষয়টি, বাস্তবিক, এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব— বিশেষত প্রশ্নটিই যেখানে ন্যায় বিচারের।
একটি বড় ধোঁয়াশা থেকেই যায়। বেআইনি ভাবে চাকরিপ্রাপ্তদের জন্য আলাদা তালিকা কিছুতেই করা গেল না কেন? বারংবার এসএসসি-কে বলা হয়েছিল তালিকা তৈরি করে দিতে। তারা তা করেনি। বিচারবিভাগ থেকে কোনও কড়া নির্দেশিকা ও চরম দিনসীমা দেওয়া হয়নি, যেমন নির্বাচনী বন্ডের ক্ষেত্রে সম্প্রতি করে দেখিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের প্রতি সম্মান রেখে ও পরিস্থিতির গুরুত্ব মনে রেখে প্রশ্নগুলি ওঠানো বিশেষ জরুরি, কেননা ভারতীয় বিচারসংহিতার একটি দার্শনিক ভিত্তিধারণা, অপরাধীকে শাস্তি দিতে না পারার থেকেও বেশি জরুরি এক জনও নিরপরাধকে শাস্তি না দিয়ে ফেলা। শাস্তি দেওয়ার আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার অপরাধীর অপরাধ বিষয়ে। এই দর্শনের স্খলন যাতে না ঘটে, তা নিশ্চিত করার দায় বিচারবিভাগেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy