—প্রতীকী ছবি।
কেবল একুশে ফেব্রুয়ারি বলে নয়, ফেব্রুয়ারি মাস এলে অথবা বছরের অন্য সময়েও বাংলা ভাষার কথা উঠলে ইদানীং বাঙালির মুখে ও কলমে উঠে আসে ভাষার রাজনীতির কথা। কী ভাবে বাংলা ভাষা খাস বঙ্গভূমেই ইংরেজির দাপটে কোণঠাসা ও দিশাহারা, কিংবা হিন্দি ভাষাভাষীর প্রবল প্রতাপ কেমন করে ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে এবং বাঙালিও তা হতে দিচ্ছে এক রকম ভাষিক আত্মঘাতের চরম মূল্যে— আত্মকরুণা ও আত্ম-সমালোচনার বিমিশ্র এই অনুভূতিই এখন তার নিত্যসঙ্গী। ভাষার রাজনীতি এক ঘটমান বাস্তব, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল বা বিস্তারের প্রশ্নটিও তার সঙ্গে জড়িয়ে। কেন্দ্রে শাসককুলের হিন্দি-প্রেম, সাংবিধানিক বহুভাষিকতার তোয়াক্কা না করে হিন্দিকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসাবে প্রচার, ছল বল ও কৌশলে জনসংস্কৃতিতেও তা চারিয়ে দেওয়া— এই তরঙ্গভঙ্গ চলেছে বাঙালির চোখের সামনে। দক্ষিণ ভারতের অটল ভাষা-অস্মিতার দুর্গ সেই ঢেউ ভাঙতে পারে না, কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে বিরোধী পশ্চিমবঙ্গে চিত্রটি ভিন্ন। এক ব্যাখ্যাতীত হীনম্মন্যতাবোধে আক্রান্ত বাঙালির আজ মনে হচ্ছে, বাংলার চেয়ে ইংরেজি ও হিন্দি আঁকড়ে ধরে তার একুশ শতকীয় জীবন সমৃদ্ধতর হবে, সুবিধা ও বাহবা মিলবে বেশি।
ভাষার রাজনীতিতে জমি পেতে গেলে ভাষাকে অস্ত্র করেই লড়তে হবে, এই যুদ্ধং দেহি মনোভাবের ও-পারে আরও একটি বাস্তবতা আছে— ভাষার আবেগ। মাতৃভাষা নিয়ে আবেগের প্রাবল্যই বাঙালিকে এগিয়ে দিয়েছিল বাংলা ভাষার প্রকৃত মর্যাদার দাবিতে আন্দোলনে, ১৯৫২-র ঢাকার রাজপথে। মাতৃভাষা নিয়ে আবেগের এক প্রবল শক্তি আছে, ভাষিক একাধিপত্যবাদী শাসকের আসন সেই শক্তি টলিয়ে দিতে পারে— সাক্ষী ঢাকা থেকে শিলচর। ভাষা নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বিস্ফার সেই ভাষা-ভাষী মানুষের মধ্যে এক সমষ্টিসত্তার জন্ম দেয়। কখনও তা তাঁদের এগিয়ে দেয় রাজনৈতিক স্বাধীনতার দিকে, কখনও জাতিগত সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের পথে। একুশে ফেব্রুয়ারি বা উনিশে মে যেমন বাংলা ভাষাকে ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন দিয়েছে, তেমনই মনে রাখা দরকার এই বাংলার সেই সব তথাকথিত অখ্যাত অপরিচিত ভাষাদেরও, হাতে-গোনা মানুষের ভাবাবেগ যে ভাষাদের মুখে নতুন করে ‘ভাষা’ জুগিয়েছে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়া একটি মানুষ তাঁর মাতৃভাষা সাঁওতালির চর্চায় জীবন পণ করছেন, বিলুপ্তপ্রায় টোটো ভাষার শব্দকোষ লিখছেন সেই ভাষাতেই ‘মা’ বলা কেউ; কুড়মি-কুড়মালির প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে ফেসবুকে একত্র হচ্ছেন সেই ভাষাকে অন্তর থেকে ভালবাসা কিছু মানুষ— এই সব দৃষ্টান্তও রয়েছে চার পাশেই।
এই আবেগে রীতিমতো ভাটার টান বলেই কি বাংলা ভাষা আজ অবমানিত? বাংলা ভাষা নিয়ে আবেগঘন সদর্থক চর্চার দিন গিয়েছে, এই আশঙ্কাই সত্যি হতে বসেছে, বিশ্বায়িত বাজার অর্থনীতির টান ভাষার আবেগকে ঠেলে দিতে পেরেছে নেপথ্যে। নতুন প্রজন্মের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি যত না স্বতঃস্ফূর্ত, তার বেশি অভ্যস্ত আনুষ্ঠানিকতা। অথচ, ভাষা দিবসের নামে যদি সত্যিই কোনও সচেতনতা তৈরি করতে হয়, তা হলে আজ আনুষ্ঠানিকতার বাড়াবাড়ি ছেড়ে এই মূল প্রশ্নগুলির আলোচনা দরকার, সমাজে, রাজনীতিতেও; গণ-পরিসরে, নীতি-নির্মাণের মঞ্চেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy