—প্রতীকী ছবি।
একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং শাসক দলের সর্বাধিনায়িকাকে যখন একুশে জুলাইয়ের বার্ষিক মহাজনসভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে দল তথা প্রশাসনের কুশীলবদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায় ‘বিত্ত নয়, বিবেক চাই’, তখন একটি সুকঠিন সত্য উপলব্ধি করতে ভুল হয় না। সত্যটি এই যে, শাসক শিবিরে বিবেকের বদলে বিত্তের চাহিদাই অতি প্রবল আকার ধারণ করেছে। আর্থিক দুর্নীতি এ দেশের কোনও রাজ্যেই বিরল নয়, অনেক রাজ্যেই দুর্নীতির অঙ্কও বিপুলতর। কিন্তু এই রাজ্যে নিরাবরণ এবং বেপরোয়া আর্থিক দুরাচার প্রশাসনের সর্বস্তরে তথা জনজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে যাওয়ার অসংখ্য অভিযোগ এবং অগণিত লক্ষণ যে ভাবে প্রতিনিয়ত প্রকট হয়ে উঠেছে, তার তুলনা ভূভারতে বেশি নেই। কেন্দ্রীয় শাসকরা রাজ্যের শাসকদের নাজেহাল করার জন্য বিবিধ গোয়েন্দা সংস্থাকে অপব্যবহার করেন, এই অভিযোগের সারবত্তা মেনে নেওয়ার পরেও এ-কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় থাকে না যে, রাজ্যের তমসাময় বাস্তব ক্রমাগত তাঁদের সেই অপব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে, দিয়ে চলেছে। মুখ্যমন্ত্রীর বিবেকবার্তাটি এই বাস্তবের পরোক্ষ স্বীকৃতি, এমন সিদ্ধান্ত কেবল সঙ্গত নয়, অবধারিত।
সমস্যা একটাই। বার্তাটি নতুন নয়। শাসক দলের নেত্রী থেকে থেকেই সহকর্মী ও অনুগামীদের লক্ষ্য করে এমন সুভাষিত বিতরণ করে থাকেন, তর্জনগর্জনও চালিয়ে যান। ভাষায় কখনও ঈষৎ পরিবর্তন ঘটে, কখনও ঘটে না, কিন্তু বক্তব্য মোটের উপরে একই থাকে: “এখন থেকে কোনও অভিযোগ কারও বিরুদ্ধে যেন দল না পায়; যদি পায়, তা হলে কিন্তু আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থা করব।” প্রশ্ন হল, উপযুক্ত ব্যবস্থা করার বাসনা যদি সত্যই থাকে, তবে এত দিন তা করা হয়নি কেন? দুর্নীতির সহস্র নিদর্শন বা লক্ষণ তো থরে-থরে ছড়ানো আছে, এমনকি জনসমক্ষে সরাসরি সেগুলি উদ্ঘাটিতও হয়েছে, তার পরেও অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ছোট মাঝারি বড় চেয়ার দখল করে বসে আছেন। বস্তুত, কেন্দ্রীয় সংস্থার চাপে একান্ত বাধ্য না হলে দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তিবিধানের ক’টা উদ্যোগ রাজ্যের শাসকদের তরফে দেখা গিয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গোয়েন্দা লাগানোর দরকার হতে পারে। এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর তিরস্কার ও চেতাবনির দাম ক’পয়সা, তিনিই জানেন।
অথবা, তিনিও জানেন না। সংশয়ের বিস্তর কারণ আছে যে, এ-রাজ্যে শাসনক্ষমতা এমন এক অনাচারের সাম্রাজ্য নির্মাণ করেছে, যার হাত থেকে ক্ষমতাবানদের নিজেদেরও মুক্তি নেই। ক্ষমতা যখন নীতি এবং নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল নিজেকে কায়েম রাখার একাগ্র সাধনায় নিমগ্ন বা নিমজ্জিত হয়, তখন সেই কানাগলি থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়া অত্যন্ত দুষ্কর। পশ্চিমবঙ্গের দুঃশাসন সম্ভবত তারই একটি দৃষ্টান্ত। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, ‘লোভ’ দমনের পাশাপাশি নেত্রীকে বারংবার দলের লোকজনদের সংযত ও বিনীত হওয়ার নির্দেশ ঘোষণা করতে হচ্ছে। এমন নির্দেশ শুনে অনুব্রত মণ্ডল বা শেখ শাহজাহানরা মনে মনে কী ভাবছেন, সে-কথা অনুমান করা কঠিন নয়। ‘ক্ষমতা বাড়লে দায়িত্ব বাড়ে’— এবংবিধ ধর্মগুরুসুলভ সুসমাচারও তো মুখ্যমন্ত্রীর মুখে বহু বার শোনা গিয়েছে, রাজ্য জুড়ে তাঁর অনুগামী তথা সাঙ্গোপাঙ্গদের দাপট কিছুমাত্র কমেছে কি? আশঙ্কা হয়, এই সব সদুক্তিকর্ণামৃত বিতরণের রীতিটি প্রকৃতপক্ষে স্থিতাবস্থাকে জারির রাখার কৌশল। সুসজ্জিত মঞ্চ থেকে বিবেকের গর্জন চলতে থাকবে, তৃণমূলে অব্যাহত থাকবে শিষ্টের দমন এবং দুষ্টের পালন। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর সহযোগীরা যদি এই আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করতে চান, করে দেখান। কথায় নয়, কাজে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কথার ফুলঝুরি দেখে দেখে ক্লান্ত, তাঁরা কাজ দেখতে চান। কাজ করতে চাইলে অবশ্য দু’টি বস্তুর দরকার হয়: সদিচ্ছা এবং সৎসাহস। দুইয়েরই ঘোর অনটন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy