—ফাইল চিত্র।
শহরজোড়া উৎসবের আলো একে একে নির্বাপিত হয়েছে। রাত্রিব্যাপী জনস্রোত থেমে ফিরেছে পরিচিত নৈশ নির্জনতা। ক্ষণস্থায়ী হেমন্তের বাতাসে ঈষৎ শিরশিরানি টের পাওয়া যাচ্ছে কখনওসখনও। সদ্য বিগত-উৎসব পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়িয়ে কেউ যদি প্রশ্ন করেন, পুজোর দিনগুলোতে কেন বহু মানুষ এমন আত্মহারা হয়ে মেতে ওঠেন আনন্দে, তার সম্ভাব্য উত্তরের তালিকা স্বভাবতই দীর্ঘ হবে। এক অর্থে, দুর্গাপূজার উৎসব প্রকৃতার্থেই গণতান্ত্রিক— সেখানে সবার সমান অধিকার। আর্থিক সামর্থ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা ইংরেজি বলার ক্ষমতা, কোনও কিছুই সেই উৎসবের প্রবেশদ্বার রোধ করে না। এমনকি, ভাষিক বা ধর্মীয় পরিচয়ও নয়। এই উৎসবে যিনিই যোগ দিতে চান, উৎসব তাঁরই। বস্তুত, বঙ্গবাসীর কাছে দুর্গোৎসবের গুরুত্বের তালিকায় ‘ধর্ম’ কথাটির স্থান সম্ভবত বেশ পরের দিকেই। হ্যাঁ, উৎসবের কেন্দ্রে রয়েছে একটি পূজা, ধর্মীয় আচারে তা হিন্দুধর্মের অন্তর্গত। কিন্তু, দশমীর দিন পানপাতা দিয়ে দুর্গাপ্রতিমার মুখটি মুছে দিয়ে যাঁরা বলেন ‘মা আবার এসো’; যে শিশুটি অসুরের বুকে বিঁধে থাকা বর্শার ফলায় লাল রং দেখে আকুল হয়ে বাবাকে বলে, ‘অসুরের ব্যথা লাগছে তো’— তাঁরা কেউই আসলে এই উৎসবে ধর্ম খোঁজেন না। মা দুর্গা দেবী, না বছরশেষে ঘরে ফেরা দুহিতা, এ তর্কে তাঁদের রুচি নেই। আপনজনের কাছে যাওয়ার জন্য আচারের অপেক্ষা উৎসব বড়। বহু মানুষ আনন্দ করছেন, সেই স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যও প্রয়োজন হয় না কোনও ছাড়পত্রের। বাংলার দুর্গাপূজা ঠিক এই কারণেই বিশিষ্ট— ধর্মকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া একটি উৎসব উত্তীর্ণ হয়েছে প্রকৃত সর্বজনীনতায়— যে আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ। সে স্রোত থেকে যে আঁজলা ভরে জীবন পান করতে চাইবে, নিত্যধারা আনন্দ তারই তৃষ্ণা নিবারণ করবে।
এ বছরও বাংলা স্থিত থাকল তার সেই সর্বজনীন সত্তায়। পাড়ার দেওয়াল জুড়ে ফুটে ওঠা আবোলতাবোল-এ, পুরনো ঘরোয়া প্রতিরূপে, এ পাড়ার ডিজ়নিল্যান্ড থেকে ও পাড়ার আইফেল টাওয়ারে, কোথাও বাংলার পল্লিশ্রী আর কোথাও বলিউডসম সেটে মানুষ ছুটে গেলেন আনন্দের সন্ধানে। কোনও মণ্ডপে কোনও কিশোরের অঞ্জলির ফুল পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ল কোনও কিশোরীর শাড়ির আঁচলে— তাতে ধর্ম ভ্রষ্ট হল বলে কেউ আপত্তি করেনি। নবমীর দিন পাঁঠার দোকানের সামনে লাইন পড়ল মাইলখানেক; মুহূর্তে উড়ে গেল হাঁড়ির পর হাঁড়ি বিরিয়ানি। বাঙালি জানে এই বাংলার মাটি তার নিজস্ব সংস্কৃতিতে বাঁচে— পুজোর ক’দিন কেউ নিরামিষ খেতে চাইলে তার আপত্তি নেই, তেমনই কেউ প্রতি দিন আমিষ ভক্ষণ করলেও তাতে কোনও বাধা নেই। বাঙালি জানে, যে যার মতো করে বেছে নেবে আনন্দের সুর— আর, সেই বিবিধ যন্ত্রের সব সুর যখন সম্মিলিত ভাবে বেজে ওঠে, জগজ্জন টের পায়, মানুষের উৎসব হচ্ছে বটে বঙ্গভূমিতে। এই ক’দিন অন্তত কেউ কারও শত্রু নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। যে এই আনন্দের ভাগীদার হতে চায়, সে-ই মিশে যেতে পারে সবার স্রোতে।
এই সংস্কৃতিকে খর্ব করা যে নেহাত সহজসাধ্য নয়, এ বারের পুজোয় কেউ কেউ টের পেলেন। রাজনীতির দাপট সর্বত্রবিহারী, সেই রাজনীতির প্রয়োজনেই অনেকে উৎসব থেকে সর্বজনীনতাকে ছেঁটে ফেলে তাকে বন্দি করতে চেয়েছিলেন ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িকতার গণ্ডিতে। টাকার অভাব হয়নি, ক্ষমতারও নয়। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী দুর্গাপূজা করতে দেন না বলে যে নেতা ভোটের বাজার গরম করতেন, তিনিই মধুর হেসে পুজো উদ্বোধন করে গিয়েছেন। সেই মণ্ডপের বাইরে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান উঠেছে, প্রতিমা নিরঞ্জনের মিছিলেও। কিন্তু তার পাশাপাশি, যেখানে নেহাত চলতি মতে পুজো চলেছে, শিল্পসুষমার টানেও একই রকম স্বতঃস্ফূর্ত ভিড় আর আনন্দধ্বনিতে মুখরিত হয়েছে বহুসংখ্যক মণ্ডপ। ধর্মের নামে বাঙালির উৎসবকে পাল্টে দিতে এসেছেন যাঁরা, তাঁদের এড়িয়ে গিয়েছেন বহুকোটি বঙ্গবাসী। এঁরা কেউ স্পষ্টত রাজনৈতিক চিন্তায় চিন্তিত না-ই হতে পারেন, ‘লিবারাল’ মতে দীক্ষিত না-ই হতে পারেন। কিন্তু তাঁরা জানেন, বাঙালির দুর্গাপূজা বিভেদ করতে শেখায় না। বাঙালির দুর্গা ঘরের আদুরে মেয়ে, দাপুটে মেয়ে। অশুভ শক্তি দলনে তিনি দশপ্রহরণধারিণী ঠিকই, কিন্তু ভ্রাতৃঘাতে তাঁর একবিন্দু রুচি নেই। এই দুর্গা আনন্দদায়িনী, বিরোধকামিনী নন। তিনি শরতেরও মা, আমজাদেরও মা। বাঙালি যত দিন এই দুর্গামূর্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারবে, এই বাংলার ভয় নেই। কোনও অশুভ শক্তি তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy