—প্রতীকী ছবি।
জন্ম বা বিবাহের দিনটি যেমন আনন্দ করে উদ্যাপন হয়, বন্ধুত্বের বার্ষিকী ঠিক তেমন করে হয় না। হয়তো তার কারণ এই যে, বন্ধুত্ব শুরুর দিনক্ষণ ঠাহর করা সহজ নয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, যেন দুধ থেকে ক্ষীর— পরিবর্তন হচ্ছে টের পাওয়া যায় বটে, তবে সে প্রক্রিয়া হতে পারে দীর্ঘ। কয়েক মাস, এমনকি বছরও যেতে পারে, দুই সহপাঠী, সহকর্মী কিংবা সমমনস্ক মানুষের ‘বন্ধু’ হয়ে উঠতে। এর মধ্যে ঠিক কোনও এক মুহূর্তকে নতুন সম্পর্কের সূচনা বলে নির্দিষ্ট করা যায় কি? ক্বচিৎ কখনও দু’জন মানুষ প্রথম সাক্ষাতেই পরস্পরের প্রতি হৃদয়ের টান অনুভব করেন, আলাপ থেকে বন্ধুত্বে পৌঁছতে সময় লাগে না। এমন ভাবে, মাত্র কয়েকটা ঘটনাবহুল দিনের মধ্যে, আজীবনের বন্ধুত্বে বাঁধা পড়েছিল বাঙালির প্রিয় দুই চরিত্র— ব্যোমকেশ আর অজিত। এ বছর তাদের বন্ধুত্বের শতবর্ষ। “সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীর সহিত আমার প্রথম পরিচয় হইয়াছিল সন তেরশ’ একত্রিশ সালে”— এই হল ‘সত্যান্বেষী’ গল্পের প্রথম বাক্য, অজিতের বয়ানে। ব্যোমকেশ সিরিজ়ের প্রথম দু’টি গল্প (‘পথের কাঁটা’ এবং ‘সীমন্ত-হীরা’) লেখার পর ব্যোমকেশ চরিত্রটিকে পাঠকের কাছে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘সত্যান্বেষী’ (মাঘ, ১৩৩৯)। ব্যোমকেশের গল্পগুলি তার চরিত্রের বৈচিত্রে, রহস্যের অভিনবত্বে, যুক্তির খেলায় দ্রুত জনপ্রিয় হয়। তবে কাহিনি ছাপিয়ে ব্যোমকেশের চরিত্রটি যে বাঙালির মনে স্থান করে নিয়েছে, তার অন্যতম কারণ এক দিকে সে যেমন ব্যতিক্রমী— বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায়, পর্যবেক্ষণের গভীরতায়, বিবেকবান স্বভাবে— অন্য দিকে সে এক সাধারণ বাঙালি যুবক, কৌতুকময়, বন্ধুবৎসল, রোম্যান্টিক প্রেমিক। সত্যবতীর সঙ্গে তার প্রেমভাবের সূচনাটি বাঙালি যুবা মাত্রেরই অতিপরিচিত। ঠিক তেমনই, অজিতের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্কে বাঙালি বন্ধুতার এক অভ্রান্ত ছাপ— হত্যাকারীকে ধরার সহায়তা থেকে দাম্পত্য কলহে মধ্যস্থতা, সবেতে অজিতের উপর ব্যোমকেশের নির্ভরতায় বাঙালি পাঠক নিজের সঙ্গে ব্যোমকেশের যোগ খুঁজে পান। বন্ধুতার এই সাব-ন্যারেটিভ ব্যোমকেশের গোয়েন্দাগিরির বড় ন্যারেটিভটিকে ‘মানবিকতর’ করে তোলে: সে ‘সুপারহিরো’ হয়ে ওঠে না।
সুকুমার সেন একে বলেছেন “পরিচয়-রস”— নিজের পরিচিত মানুষের মেলায় একটি চরিত্রকে দেখতে পেলে তার প্রতি যে বাড়তি ভাল লাগার সঞ্চার হয়, তা এই রসের জন্যই। ব্যোমকেশের চরিত্রকে সেই রসে সিক্ত করেছেন শরদিন্দু, অজিতের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব দিয়ে। রসটি স্মৃতিরও, শরদিন্দু একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তাঁর বাল্যবন্ধু অজিত সেনের নামে চরিত্রের নাম রেখেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের আলোচকরা এই সম্পর্কের তুলনা করেছেন শার্লক হোমস আর জন ওয়াটসনের বন্ধুত্বের সঙ্গে (আ স্টাডি ইন স্কারলেট উপন্যাসে ওয়াটসনের বয়ান অনুসারে সেই সম্পর্কের বয়স ১৪৩ বছর)। তবে এই দুই বন্ধুত্বের চরিত্র আলাদা। ওয়াটসনের সঙ্গে হোমসের সম্পর্কে একটা অসাম্য রয়েছে— হোমস যেন কিছুটা করুণামিশ্রিত দৃষ্টিতে দেখে তার সঙ্গীকে। অবশ্য আর্থার কোনান ডয়েলের চাইতে চলচ্চিত্র পরিচালকদেরই অনেকে দায়ী করেছেন, ওয়াটসনকে বোকাটে, কমিক চরিত্র করে তোলার জন্য। শরদিন্দু এবং কোনান ডয়েল, দু’জনেই সিরিজ়ের শুরুতে বন্ধুর বয়ানে অ্যাডভেঞ্চারের বিবরণ দিয়েছেন, কিন্তু পরে বন্ধুকে সরিয়ে দিয়েছেন কথকের ভূমিকা থেকে। লেখকই হয়েছেন কথক, স্বয়ং গোয়েন্দার হাতেও কলম ধরিয়েছেন। কোন কৌশল কতটা উতরেছে, তা সাহিত্যের বিতর্ক। তবে প্রশ্নাতীত যে হোমস বা ব্যোমকেশকে পাঠকের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠার কাজটি করেছিল ‘পরিচয়-রস।’
কোন অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির লেখকই বা বন্ধুত্বের রস গল্পে আনার লোভ ছাড়তে পেরেছেন? হেমেন্দ্রকুমার রায় যখন দুই বাঙালি যুবককে বন্দুক-হাতে পাঠিয়েছিলেন খাসিয়া পাহাড়ে ‘যকের ধন’ (১৯২৩) সন্ধান করতে, তখন কুমারের বয়ানেই সে গল্প এসেছে পাঠকের কাছে। বিমল-কুমারের বন্ধুত্ব অতএব সদ্য শতবর্ষ পেরোল। বন্ধুত্বের এমনই দাবি যে, সত্যজিৎ রায় ছোট ভাই তোপসের হাতে কলম ধরিয়েও, তাঁর গোয়েন্দা ফেলু মিত্তিরের বন্ধুর ভূমিকায় এনেছিলেন লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে জটায়ুকে। না হলে ফেলুদার চরিত্রের পরিহাসপ্রিয়, সংবেদনশীল দিকটা তেমন করে প্রকাশ পেত কি? সোনার কেল্লা চলচ্চিত্র, যা জটায়ুকে বাঙালি মানসে এক অবিস্মরণীয় চরিত্র করে তুলেছে, তা এ বার পঞ্চাশ বছরে পা দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy