ফাইল চিত্র।
রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করিবার রাষ্ট্রীয় প্রবণতার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট কঠোর অবস্থান গ্রহণ করিতেছে, তাহা আশার কথা। সাংবাদিক বিনোদ দুয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা নাকচ করিয়া শীর্ষ আদালতের বিচারপতি উদয় উমেশ ললিত ও বিনীত সরণের বেঞ্চ জানাইল, সরকারের সমালোচনা করা রাষ্ট্রদ্রোহ নহে; এবং, ভিন্ন মত প্রকাশ করিবার পক্ষে দেশের প্রত্যেক সাংবাদিকের রক্ষাকবচ রহিয়াছে। সত্য, এই অধিকার লঙ্ঘিত হইলে বাক্স্বাধীনতার সংবিধানসিদ্ধ অধিকারটি অর্থহীন হইয়া পড়ে। মিডিয়ার একাংশ দ্বিধাহীন স্তাবকতায় মাতিলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সরকারের এবং নেতাদের সমালোচনা করিয়াছে, গণতন্ত্র হইতে চ্যুতিগুলির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়াছে। এক কথায়, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করিয়াছে। যে নেতা সাত বৎসরে এক বারও সাংবাদিক সম্মেলন করেন নাই, তাঁহার নিকট সংবাদমাধ্যমের এই বাক্স্বাধীনতা সম্ভবত অসহ্য হইয়াছে। তাঁহার অনুগামীদের নিকটও। ফলে, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ সংবাদমাধ্যমকে ধাওয়া করিয়া ফিরিয়াছে। উল্লেখ্য, তেমনই এক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলিয়াছিলেন, এই আইনটির সীমা নির্ধারণের সময় আসিয়াছে।
কাহাকে শায়েস্তা করিতে হইলে নেতারা পূর্বে মানহানির মকদ্দমা ঠুকিতেন, এখন রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়— প্রাক্-মোদী ভারতের সহিত মোদী-পর্বের এহেন তুলনাকে এক কথায় উড়াইয়া দেওয়া অসম্ভব। এই বৎসরের গোড়ায় এক অসরকারি সংস্থা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার হিসাব পেশ করিয়াছিল— গত এক দশকে মোট ৪০৫ জন ভারতীয়ের বিরুদ্ধে কোনও নেতা বা সরকারের সমালোচনার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা হইয়াছে; তাহার ৯৬ শতাংশ মামলাই হইয়াছে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসিবার পর। ১৪৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্বন্ধে অপমানজনক মন্তব্য করিবার কারণে; ১৪৪ জন রাজরোষে পড়িয়াছেন যোগী আদিত্যনাথের সমালোচনা করিয়া। উল্লেখ্য, নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলাকালীন দায়ের হইয়াছিল ২৫টি মামলা, হাথরস ধর্ষণকাণ্ডের পর ২২টি, পুলওয়ামা হামলার পর ২৭টি। অর্থাৎ, যখনই সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের স্বর শুনা গিয়াছে, নরেন্দ্র মোদী-আদিত্যনাথরা তাহাকে দমন করিয়াছেন রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার হাতিয়ারে। শুধুই কি এই কারণে যে, আইনটি অতিশয় কঠোর? ইহা কারণ বটে, কিন্তু একমাত্র নহে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া ইস্তক নরেন্দ্র মোদী নিজেকে ব্যক্তির ঊর্ধ্বে, রাষ্ট্রের সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিয়াছেন— তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নহেন, তিনিই ভারত, এই কথাটি জনমানসে গাঁথিয়া দিতে চাহিয়াছেন। ফলে, তাঁহার সমালোচনাকে তিনি ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলিয়া দেখেন, দেখাইতে চাহেন। নিজেকে রাষ্ট্রের সহিত অভিন্ন করিয়া দেখানো একনায়কের অভিজ্ঞান। আদিত্যনাথরা তাঁহার নিকট এই কৌশলের পাঠ লইতেছেন, এবং হাত পাকাইতেছেন।
১৯৫১ সালে পঞ্জাব হাই কোর্ট, এবং ১৯৫৯ সালে ইলাহাবাদ হাই কোর্ট ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনকে তামাদি ঘোষণা করিলেও ১৯৬২ সালে যে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতাকে স্বীকৃতি দিয়াছিল, বিচারপতি ললিত ও সরণের বেঞ্চ সেই কেদারনাথ মামলার উল্লেখ করিয়াছেন। স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যে, সেই রায়েই বলা হইয়াছিল, ভিন্ন মত প্রকাশ করা, প্রশ্ন করা রাষ্ট্রদ্রোহিতা নহে। নেতা-মন্ত্রীরা যে রাষ্ট্র নহেন, তাঁহাদের অপকর্মের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিলে যে রাষ্ট্রের প্রভূত উপকার হয়, একনায়কতন্ত্রের মুখের উপর কথাটি বলিয়া দেওয়া প্রয়োজন ছিল। শীর্ষ আদালত সেই জরুরি কাজটি করিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy