—প্রতীকী চিত্র।
বাক্সংযম ভাল। বিশেষত সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিসরে যখন কেবল অসার কথার ফুলঝুরিই ফোটে না, ঠাস ঠাস দ্রুম দ্রাম রবে কদর্য অশোভন শব্দব্রহ্মের নিরন্তর বিস্ফোরণ ৯০ কিংবা ১২৫ ডেসিবেলের সীমা ছাড়িয়ে মহাবিশ্বে মহাকাশে আলোড়ন সৃষ্টি করে, তখন শান্তিপ্রিয় নাগরিক অতিষ্ঠ হয়ে স্মরণ করতেই পারেন ল্যাকোনিয়া-র কথা— প্রাচীন গ্রিসের সেই রাজ্য, যার রাজধানী ছিল স্বনামধন্য স্পার্টা, যার নাম থেকে এসেছে ইংরেজি ‘ল্যাকোনিক’ শব্দটি, কারণ সেখানকার লোকেরা নাকি যে কথা এক অক্ষরে বলা যায় তার জন্য দু’টি অক্ষর খরচ করতে নারাজ ছিলেন। মনে পড়তে পারে গত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক লুডউইগ উইটগেনস্টাইন সম্পর্কে প্রচলিত গল্পটিও— নির্জন পথে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ এবং শব্দহীন পদচারণার পরে তরুণ ছাত্রটি, নিতান্তই অস্বস্তিবশত, বলেছিলেন: ‘দিনটা বেশ মনোরম’, এবং তৎক্ষণাৎ তার দিকে শীতল দৃষ্টিবাণ নিক্ষেপ করে মাস্টারমশাই জবাব দিয়েছিলেন: বলার কথা না থাকলেও কথা বলতেই হবে?
এখন দুনিয়া জুড়ে চিকিৎসক, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের অবশ্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে নীরবতা। শিশুদের নীরবতা। শৈশবের যে পর্বে যতটা কথা বলা স্বাভাবিক, বহু শিশু তা বলছে না। আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং স্থানীয়, সমস্ত স্তরের বিভিন্ন সমীক্ষায়, সংবাদ প্রতিবেদনে এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় এই সমস্যা উত্তরোত্তর প্রকট হচ্ছে। আমেরিকার এক বিশেষজ্ঞ সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা জানিয়েছে: ২০১৮ ও ২০১৯ মিলিয়ে এক থেকে বারো বছর বয়সিদের মধ্যে যত শিশুর মধ্যে বয়সোচিত কথা বলার অক্ষমতা ধরা পড়েছিল, ২০২২ সালে সংখ্যাটা তার প্রায় তিন গুণ। কলকাতা শহরের চিকিৎসক, মনোবিদ ও শিক্ষকদের অনেকের অভিজ্ঞতা এই পরিসংখ্যানের অনুগামী। গত দু’বছরে তাঁরা এমন অনেক বেশি শিশুকে দেখেছেন যারা স্বাভাবিক মাত্রায় কথা বলতে পারছে না, বলতে চাইছে না। কেন এই প্রবণতা? বিজ্ঞানসম্মত কার্যকারণসূত্র নির্ধারণে আরও অনেক সমীক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজন, সেই কর্মকাণ্ড নানা স্তরেই চলছে। তবে একটি সূত্র মোটের উপর সুস্পষ্ট। তার নাম কোভিড। অতিমারির পর্বটিতে বহু দেশেই, বিশেষত শহরে, শিশুরা সম্পূর্ণ ঘরবন্দি ছিল, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা দূরস্থান, এমনকি পরিবারের মানুষের সঙ্গে আদানপ্রদানও ভয়ানক ভাবে কমে গিয়েছিল। অনেকের দৈনন্দিন জীবনেই স্বাভাবিক কথাবার্তা বলা এবং শোনার স্থান নিয়েছিল একটি বস্তু: মোবাইল টেলিফোনের পর্দা। এই শিশুরা বড় হয়েছে কার্যত কথোপকথনের বাইরে, সুতরাং তাদের কথা বলার সক্ষমতা এবং অভ্যাস দুইয়েরই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সারা দিন নানা ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে নানা ধরনের কথা শুনতে শুনতেই ছোটরা নিজেদের ভাষা খুঁজে নেয়। সেই পথ বন্ধ হয়ে গেলে পরিণাম ভাল হবে না, এ অতি স্বাভাবিক, কার্যত অনিবার্য।
অতিমারির ক্ষয়ক্ষতি হয়তো ক্রমশ পূরণ করা যাবে। মানুষ নামক প্রজাতিটির আত্মসংশোধনের ক্ষমতা কম নয়, সুতরাং কোভিডকালের শিশুরা বড় হতে হতেই তাদের হারানো বা না-পাওয়া কথাগুলি খুঁজে নেবে। কিন্তু মূল সমস্যা অতিমারির অস্বাভাবিক পর্বটিতে সীমিত নয়, যাকে ‘স্বাভাবিক’ জীবন বলা হচ্ছে তার পরতে পরতে একই সমস্যার শিকড় বহু দূর অবধি প্রসারিত হয়েছে। নাগরিক শিশুদের একটি বড় অংশের দৈনন্দিন জীবনে এখন পারিবারিক তথা সামাজিক কথোপকথনের অবকাশ অত্যন্ত সীমিত। সকাল থেকে রাত্রি অবধি তারা হয় বাঁধাধরা পঠনপাঠনের তোতাকাহিনির ঘানি ঘুরিয়ে চলে, অথবা হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইলের পর্দায় নিবিষ্ট হয়ে থাকে। তারা পরিবেশ ও প্রতিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। অতিমারি এই বিচ্ছিন্নতাকে এক চরম রূপ দিয়েছিল, এই মাত্র। চার পাশের স্বাভাবিক জীবন থেকে প্রতিনিয়ত বিচ্ছিন্ন হয়ে দিনযাপনের এই অভ্যাস কেবল শিশুদের— এবং বড়দেরও— কথা হরণ করে না, তাদের মানবিক সত্তাকেও খর্বিত করে। খর্বিত হয় জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাদের কৌতূহল তথা জিজ্ঞাসা, খর্বিত হয় অন্য মানুষের প্রতি সহমর্মিতা। এক অর্থে— যন্ত্রকে ‘কৃত্রিম মেধা’ সরবরাহ করে মানুষ করে তোলার বিপ্রতীপ প্রক্রিয়ায়— মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করার একটি উদ্যোগই এই ভাবে জোরদার হয়ে ওঠে। এবং, সেই যন্ত্রমানব যতই প্রকৃত সংযোগের ভাষা হারিয়ে ফেলে, ততই তার গলার জোর বাড়তে থাকে, কথোপকথনের বদলে শোনা যায় কেবল চিৎকার, আলোচনার স্থান নেয় শুধু মিছেকথা, ছলনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy