Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Politics

তবু প্রশ্ন

রাজনৈতিক দলের আচরণের ঔচিত্য-অনৌচিত্য বিষয়ে নীতিগত আলোচনা করে আদৌ আর কোনও লাভ আছে কি না, সে প্রশ্ন নিতান্ত স্বাভাবিক।

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২২ ০৫:০২
Share: Save:

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পর্ক কী হওয়া উচিত? গত সপ্তাহে এশিয়াটিক সোসাইটিতে অনুষ্ঠিত একটি সভায় সমাজবিদ্যার প্রবীণ শিক্ষক কল্পনা কানাব্রিয়ান মন্তব্য করেছেন যে, সরকার যেমন জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধ, রাজনৈতিক দলেরও সেই দায় স্বীকার করা দরকার; এমনকি সেই দায়বদ্ধতাকে সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেওয়ারও যুক্তি আছে। রাজনৈতিক দলগুলি আর পাঁচটা বেসরকারি সংগঠনের মতো নয়, তারা একটি ‘পাবলিক বডি’ অর্থাৎ জনপরিসরের প্রতিষ্ঠান, জনসমর্থন পাওয়ার জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, সুতরাং প্রতিটি কাজের জন্য জনসাধারণের কাছে তাদের জবাবদিহির দায় থাকা উচিত। দলীয় রাজনীতির মূর্তি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে রাজনৈতিক দলের আচরণের ঔচিত্য-অনৌচিত্য বিষয়ে নীতিগত আলোচনা করে আদৌ আর কোনও লাভ আছে কি না, সে প্রশ্ন নিতান্ত স্বাভাবিক। কিন্তু সকাল থেকে রাত্রি অবধি অনন্ত কুনাট্যের মধ্যে কেউ এই বিষয়ে একটি মূল্যবান প্রশ্ন তুললে তাকে সম্মান জানানো সমাজের কর্তব্য। দলনেতা ও নেত্রীরা তাতে হয়তো কর্ণপাতও করবেন না, কিন্তু তাঁদের অনেকের অনেক আচরণ যে যথার্থ রাজনীতি নয়, রাজনীতির কলঙ্ক, সেই সত্যটি অন্তত সমাজের নিজের মনে রাখা জরুরি।

প্রকৃত গণতন্ত্রের শর্ত পূর্ণ হলে এই দায়িত্বের কথা আলাদা করে বলার দরকার হত না। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলকে জনসাধারণের সমর্থন নিয়ে চলতে হয়— সুতরাং তাঁদের কাছে দায়বদ্ধ না থাকলে জনসমর্থন হারাতে হবে, এই সম্ভাবনার তাড়নাতেই দলের নেতা ও কর্মীদের আচরণ যথাযথ হওয়ার কথা, ভুল করলে দ্রুত আত্মসংশোধন করার কথা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দলের সঙ্গে জনতার সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে দাতা এবং গ্রহীতার। নানা ভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের স্বার্থ সিদ্ধি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনৈতিক দল ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে, যত ক্ষণ ভোটদাতাদের চোখে সেই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়, অন্তত প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়, তত ক্ষণ দলের আচরণ যেমনই হোক না কেন, ভোট ঝুলিতে জমা পড়তে থাকে। এই ভাবেই গণতন্ত্র পরিণত হয়েছে দলতন্ত্রে। দলতন্ত্রের অভিধানে নৈতিক দায়দায়িত্বের কোনও স্থান নেই। দলীয় রাজনীতির যে রূপ এখন প্রকট, তা এই অভিধানের নিয়ম মেনেই নির্মিত।

এখানে সমস্যার শেষ নয়, শুরু। দীর্ঘ দিনের অভ্যাসে ও অনুশীলনে ভোটদাতারাও রাজনৈতিক দলের কাছে নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রত্যাশা বহুলাংশে হারিয়ে ফেলেছেন, ফলে আজ আর এই বিষয়ে দলনেতাদের উপর তাঁদের দিক থেকেও বিশেষ কোনও চাপ সচরাচর কাজ করে না। তাঁরা ধরেই নিয়েছেন যে, রাজনৈতিক দল এই ভাবেই চলবে, ক্ষমতা হাতে থাকলে যথেচ্ছ আচরণ করবে। এই কারণেই দেখা যায়, আর্থিক দুর্নীতি বা অন্য ধরনের অন্যায়ের দায়ে অভিযুক্ত হলে, এমনকি অভিযোগ প্রমাণিত হলেও দলনেতারা জোর গলায় আস্ফালন করে বলেন, তাঁরা জনতার আদালতে নিজেদের অটুট মহিমা প্রমাণ করে দেবেন। এবং অনেক সময়েই সেই আস্ফালন সত্য প্রমাণিত হয়! এহ বাহ্য। ক্রমশই দেখা যাচ্ছে, জনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যেই রাজনীতিকদের একাংশ দুর্বিনীত, অসংযত, হিংস্র আচরণে মত্ত হচ্ছেন, বিশেষত সেই হিংস্রতার লক্ষ্য যেখানে কোনও চিহ্নিত ‘প্রতিপক্ষ’। বস্তুত, সংখ্যাগুরুবাদী রাজনীতির কারবারিরা এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং সমাজের পক্ষে হানিকর আচরণকেই নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে চলেছেন। এই পরিস্থিতিতে সমাজবিজ্ঞানীর সুপরামর্শ আদৌ কতটুকু ফলপ্রসূ হতে পারে, সেই সংশয় অবশ্যই থেকে যায়। কিন্তু সেই কারণেই কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। অন্ধকার আদিগন্ত বিস্তৃত হলে প্রদীপের শিখাটুকুই সম্বল।

অন্য বিষয়গুলি:

Politics common people
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE