হাওড়ার আন্দুল রোডের চুনাভাটিতে সম্প্রতি যে ভয়াবহ ধর্ষণকাণ্ড ঘটিল, নৃশংসতায় তাহা দিল্লি, অথবা হাথরসের কথা স্মরণ করাইবে। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পর নয় বৎসর কাটিয়া গেল, কিন্তু পরিস্থিতি বদলাইল না। নারী সুরক্ষার জন্য নির্ভয়া তহবিল গঠিত হইল বটে, কিন্তু তাহার প্রকৃত ব্যবহার হইল অতি সীমিত। বিচারপতি জে এস বর্মার অধীনে কমিটি গঠিত হইল, সেই কমিটি রিপোর্টও পেশ করিল এক বৎসরের মাথায়— কিন্তু, বাস্তবে তাহার ছাপ পড়িল না। নির্ভয়ার ধর্ষকদের ফাঁসি হইয়াছে কি না, এক্ষণে সেই প্রশ্নটি গৌণ। ধর্ষণের ন্যায় অপরাধ করিলে কঠোরতম শাস্তি পাইতে হইবে, এই বোধটি সমাজের মধ্যে প্রোথিত হইল না। বরং, ধর্ষণের সহিত আরও নৃশংস শারীরিক অত্যাচারের ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পাইল। কেন, সেই প্রশ্নের একটি দীর্ঘতর উত্তর হইল, সমাজে নারীর প্রতি সম্ভ্রমের বোধটি তৈরি করিয়া উঠা সম্ভব হয় নাই; এবং হ্রস্বতর উত্তর হইল, সম্ভাব্য অপরাধীদের কঠোর শাস্তির ভীতি জন্মায় নাই। সেই ভীতি তৈরি করিবার উপায় হইল, যে কোনও ধর্ষণের ঘটনায় আপসহীন তদন্ত, মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি, এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। ভারত সেই কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়াছে।
ব্যর্থতার মূল কারণ রাজনীতি। গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্য, ধর্ষণের ন্যায় একটি ঘৃণ্য অপরাধও রাজনীতির সহিত বহু মাত্রায় জড়িত। পরিচিতির রাজনীতি যাঁহাকে ‘অপর’ বলিয়া প্রতিষ্ঠা করে, সেই গোষ্ঠীর নারীর উপর যৌন নির্যাতন বর্তমান ভারতে একটি ‘স্বীকৃত’ রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হইয়াছে। সংখ্যালঘুকে ‘শাসন’ করিতে, নিম্নবর্ণকে সমাজে ‘তাহার স্থানটি দেখাইয়া দিতে’ ধর্ষণ পরিচিত অস্ত্র ছিল, এবং আছে। এই অস্ত্র যাহারা প্রয়োগ করিয়া থাকে, তাহারা সচরাচর ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ, ফলে আইনের হাত সেই অবধি পৌঁছাইতে পারে না। হাথরসের ধর্ষকদের ক্ষেত্রেই যেমন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার রাজনীতি সরাসরি পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়ায়। জম্মুর কাঠুয়ায় এক নাবালিকার ধর্ষণকারীদের সমর্থনে মিছিল বাহির করিয়াছিলেন দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতা; উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে অভিযুক্তকে মালা পরাইয়া বরণ করিয়া লন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এই অপরাধীদের শাস্তি দিবে, আইনের তেমন সাধ্য কোথায়? কোনও ক্ষেত্রে আবার ধর্ষণের অভিযোগকে বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র বলিয়া উড়াইয়া দিয়াছেন রাজ্যের শীর্ষনেত্রী। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ড বা কামদুনি কাণ্ডের কথা স্মরণে আসিতে পারে।
ধর্ষকদের রাজনৈতিক নিরাপত্তা দিবার যে সর্বগ্রাসী প্রবণতা সমগ্র দেশে, এবং পশ্চিমবঙ্গেও তৈরি হইয়াছে, একের পর এক ভয়াবহ ঘটনা তাহারই ফল। ধর্ষণের শাস্তি নাই, এই কথাটি অপরাধীরা বিশ্বাস করিয়া লইয়াছে। হাওড়ার আলোচ্য ঘটনাটি তাহার উদাহরণ। মাঠেঘাটে নহে, অন্ধকারে নহে— দিনের বেলা, নিগৃহীতার বাড়িতে ঢুকিয়া তাহাকে ধর্ষণ করিতে কতখানি সাহস প্রয়োজন হয়, তাহা ভাবিয়া দেখা বিধেয়। এই অপরাধীদের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক যোগ আছে কি না, সেই প্রশ্ন অবান্তর। অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রশ্রয় দেওয়ার প্রবণতাটি যে এই অপরাধটিকে মুড়ি-মুড়কি করিয়া তুলিয়াছে, তাহাই আসল কথা। এবং, সেই নিরিখে উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দূরত্ব নিতান্ত কম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy