Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Voter Card

নজরদারি

অতঃপর সরকার চাহিলে কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর প্রাথমিকতম গণতান্ত্রিক অধিকারটুকুও হরণ করিতে পারিবে।

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:০৬
Share: Save:

দেশের সংবিধান সাধারণ মানুষকে যে অধিকার দিয়াছে, গণতন্ত্রের বহিরঙ্গটুকু বজায় রাখিয়াও সেই অধিকারের সর্বস্ব হরণ করিবার সহজতম পন্থাটি হইল ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর অজুহাত খাড়া করা। কেন্দ্রীয় সরকার আরও দুই ক্ষেত্রে এই অস্ত্রটি ব্যবহার করিল। নির্বাচনী পরিচয়পত্রের সহিত আধার কার্ড সংযুক্তিকরণের বিল পাশ হইয়া গেল সংসদের উভয় কক্ষে। অবশ্যই ‘জাতীয় স্বার্থে’। কেন্দ্রীয় সরকার জানাইয়াছে, অ-নাগরিকরা যাহাতে ভোট না দিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করিবে এই ব্যবস্থা। প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নির্মাণের সময় যে আধার কার্ড কোনও মতেই নাগরিকত্বের পরিচয় হিসাবে গণ্য হয় না, ভোটের ক্ষেত্রে কোন জাদুতে তাহা অ-নাগরিকদের চিহ্নিত করিবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, যেখানে ভোটার পরিচয়পত্র ও আধার সংযুক্তিকরণ ‘ঐচ্ছিক’, সেখানে কী ভাবে কোনও উদ্দেশ্য সাধিত হইতে পারে? অতএব, অনুমান করা চলে, সংযুক্তিকরণকে ‘ঐচ্ছিক’ ঘোষণা করা হইল তাঁবুতে মুখটুকু গলাইবার জন্য উটের ছলনামাত্র— শীর্ষ আদালত যে রায়ই দিক না কেন, ঘুরপথে হইলেও সরকার এই সংযুক্তিকরণকে কার্যত বাধ্যতামূলক করিয়া তুলিবে, সর্বক্ষেত্রে আধার-এর ব্যবহারকে যেমন করিয়াছে। আধার-এর তথ্যভান্ডারের সহিত ভোটার কার্ড জুড়িলে নাগরিকের ‘প্রোফাইলিং’ সম্পূর্ণ হইবে, ফলে আশঙ্কা যে, অতঃপর সরকার চাহিলে কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর প্রাথমিকতম গণতান্ত্রিক অধিকারটুকুও হরণ করিতে পারিবে। যে ভঙ্গিতে বিরোধীদের আপত্তিকে উপেক্ষা করিয়া, সংসদের পরিসরে আলোচনার সুযোগমাত্র না রাখিয়া সরকারপক্ষ বিলটি পাশ করাইয়া লইল, তাহাতে এই আশঙ্কা তীব্রতর হইতেছে।

সংসদীয় যৌথ কমিটি নাগরিকের তথ্য নিরাপত্তা বিল, ২০১৯ সম্বন্ধে যে অবস্থান লইল, তাহাও নিতান্তই ‘জাতীয় স্বার্থে’। বেসরকারি সংস্থার ক্ষেত্রে তথ্য বিষয়ক যে কঠোর নিয়মবিধি প্রস্তাবিত হইয়াছে, সরকারের ক্ষেত্রে তাহার বালাই নাই। ‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে’ কোনও সরকারি সংস্থা যদি নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যে বা পরিসরে নজরদারি চালায়, তাহা ঠেকাইবার মতো কোনও আইনের ব্যবস্থা ভারতে নাই। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন কোনও বিভাগ নিতান্ত ঠুনকা অজুহাতেও তথ্য নিরাপত্তা আইনের বিধিনিষেধ এড়াইয়া যাইতে পারিবে— অবশ্যই ‘জাতীয় স্বার্থ’ রক্ষার্থে। বস্তুত, সংসদীয় কমিটি যে ব্যবস্থা করিয়াছে তাহাতে আশঙ্কা, কোনও ক্ষেত্রে তথ্য নিরাপত্তা আইন উল্লঙ্ঘন করা হইলে তাহা যে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থেই করা হইয়াছে, এই কথাটুকু প্রমাণ করিবার দায়ও কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির থাকিবে না— উল্লঙ্ঘনের ঘটনাটিই যথেষ্ট প্রমাণ হিসাবে বিবেচিত হইবে। তথ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবদের নিয়োগ করিবার প্রস্তাবটিও নিরপেক্ষতার মাত্রা বাড়াইবে না।

দেশের সংবিধান নাগরিককে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার যে অধিকার দিয়াছে, তাহা লঙ্ঘন করিতে কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ বারে বারেই প্রকট। শাসকরা স্পষ্টতই একটি নজরদারি রাষ্ট্র গড়িতে চাহেন, যেখানে নাগরিকের প্রতিটি মুহূর্ত রাষ্ট্রের অতন্দ্র নজরদারির অধীন হইবে। তাহাতে বিরোধী স্বর দমনের সুবিধা হইবে নিশ্চিত, কিন্তু সেই ব্যবস্থাটি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। শাসকের হাতে লাগামহীন ক্ষমতা, নাগরিক স্বর দমন, বিরোধিতার পরিসর খণ্ডন— এইগুলি গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ হইতে পারে না। আরও আশঙ্কা, নাগরিকের এই বিপুল তথ্য রক্ষা করিবার সামর্থ্যও কি কেন্দ্রীয় সরকারের রহিয়াছে? এই তথ্যভান্ডারে ডাকাতি হইবে না, তেমন কোনও নিশ্চয়তা আছে কি? অভিজ্ঞতা বলিতেছে, নাই। ফলে, মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে নজরদারির অদম্য উৎসাহে কেন্দ্রীয় সরকার কোন বিপদের পথে দেশকে লইয়া যাইতেছে, তাহা সুগভীর উদ্বেগের বিষয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Voter Card Aadhar card
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy