কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ও প্রকল্প রূপায়ণ মন্ত্রকের বার্ষিক শিল্প সমীক্ষার প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের শিল্পোন্নত রাজ্যগুলির তুলনায় কলকারখানা তৈরিতে এখনও পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। এটা নতুন কোনও কথা নয়। যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শিল্পের মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গ ছিল একবারে উপরের দিকে। সেই সময় অন্য শিল্পোন্নত রাজ্যটি ছিল তৎকালীন বোম্বাই প্রদেশ— এখনকার মহারাষ্ট্র ও গুজরাত মিলিয়ে। এই দু’টি রাজ্য এখনও শিল্পে তাদের উন্নয়নের ধারা বজায় রেখেছে। ইতিমধ্যে তামিলনাড়ুর মতো কিছু রাজ্যও শিল্পের মাপকাঠিতে উঠে এসেছে প্রথম সারিতে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ রাজ্যে মোট যত কারখানা রয়েছে, তার তুলনায় তামিলনাড়ুতে রয়েছে চার গুণ আর গুজরাত, মহারাষ্ট্রে প্রায় তিন গুণ।
কেন এ ভাবে পিছিয়ে পড়ল এ রাজ্য? কারণ নানাবিধ। পঞ্চাশের দশকে কেন্দ্রীয় সরকারের মাসুল সমীকরণ নীতির ফলে প্রাথমিক ভাবে ধাক্কা খায় রাজ্যের শিল্প। রয়েছে পরিকাঠামোগত খামতিও। যে সব রাজ্য শিল্পে উন্নতি করেছে, তার প্রতিটিতেই পরিকাঠামোর উপরে জোর দিয়েছিল। এ সবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বামপন্থীদের আত্মঘাতী শিল্পবিরোধী আন্দোলন নীতি। বন্ধ, হরতাল, ঘেরাওয়ের ফলে শিল্প গড়ে উঠতে পারল না। শাসনকালের শেষের দিকে বামেরা শিল্পায়নের চেষ্টা করলেও, তাদেরই পুরনো মানসিকতাকে আঁকড়ে জমির প্রশ্ন তুলে তৎকালীন বিরোধী দল সেই উদ্যোগ বানচাল করে দেয়। বর্তমান সরকার রাজ্যে শিল্প আনার প্রচেষ্টায় বার্ষিক ‘শিল্প সম্মেলন’-এর আয়োজন করে বটে, কিন্তু জমির জট এখনও বর্তমান; সেই সঙ্গে রয়েছে সিন্ডিকেটের উপদ্রবও। ফলে সদিচ্ছা থাকলেও এ রাজ্যে শিল্প থেকে গিয়েছে দুয়োরানি হয়েই।
কিন্তু এটাও ভাবার যে, এই শিল্পঘাতী রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে পায়ের নীচে জমি পেল কী ভাবে? তা তখনই সম্ভব, যখন মানুষের এই রাজনীতির প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন থাকে। কেউ বলতে পারেন, বাংলার মানুষ স্বভাবগত ভাবেই শিল্পবিমুখ। বাংলায় নবজাগরণের ইতিহাস এক দিকে যেমন পড়াশোনার উন্নতি ঘটিয়েছে, তেমনই অন্য দিকে রাজ্যের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষাকে পেশাজীবী হওয়ার দিকে নিয়ে গিয়েছে। ফলে সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে নিজেদের ব্যবসা গড়ে তোলার বদলে স্কুলমাস্টারি বা সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকেছে। অন্য দিকে, তামিলনাড়ু বা অন্য শিল্পোন্নত রাজ্যগুলিতে গোষ্ঠীগত ভাবে ব্যবসায়িক মানসিকতা শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। মূলত একই কারণে পড়শি বাংলাদেশও এক সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মতো পরিস্থিতিতে থেকেও বস্ত্রশিল্পে বহু গুণ এগিয়ে গিয়েছে। শিল্পের সঙ্গে এই বিচ্ছিন্নতার ফলেই ধীরে ধীরে নিম্নগামী হয়েছে এ রাজ্যের শিল্প। ফলে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পকে ফিরিয়ে আনতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানসিকতার বদল। সঙ্গে এই রাজ্যে শিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে অন্তরায়গুলি এত দিন পরিলক্ষিত হয়েছে, তা সরানোর ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। রাজ্যের মানুষের মধ্যে শিল্পের প্রতি আকাঙ্ক্ষা, শিল্পের চাহিদা তৈরি না হলে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পহীনই থেকে যাবে— শুধু দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিক জোগাবে গোটা দেশকে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy