বর্ণময় ঋতু উৎসব, ‘বসন্তের উৎসব’। ফাইল ছবি।
একশো বছর আগে, ১৯২৩ সালে, প্রথম বার শান্তিনিকেতনে বসন্তের আসর বসেছিল। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় আশ্রম-সম্মিলনীর অধিবেশনে বসন্তোৎসবের আয়োজন হয়েছিল। এর আগে এমন আসরের কথা আর জানা যায় না, যদিও বসন্তের গান গাইতে গাইতে আশ্রম পরিক্রমার রেওয়াজ ছিল তার আগেও। কিন্তু নিয়মিত ভাবে ফাল্গুনী পূর্ণিমার আয়োজনের শতবর্ষ পূর্ণ হল, বললে ভুল হবে না। এই অবকাশে আর এক বার পুরনো প্রশ্নের উত্তরটি ঝালিয়ে নেওয়া দরকার। বসন্তোৎসব, দোল ও হোলি কি সমার্থক? আপাত ভাবে তা-ই। অথচ নিহিতার্থটি আলাদা, অনেকখানি আলাদা। হোলির সঙ্গে হোলিকা দহনের কাহিনি মিশে আছে। হোলিকা নামের অসুর-রমণীকে দহন করার অর্থ অশুভ শক্তির বিনাশ। অশুভকে বিনাশ করে রঙের উৎসব শুরু করা হয়। হোলিকা নাশের গল্প থেকে হোলি উৎসবের উৎপত্তি। আর দোলের মধ্যে মিশে রয়েছে বৈষ্ণবতা। বৃন্দাবনে কৃষ্ণ, রাধা ও অপর গোপীদের সঙ্গে রং খেলতেন— সেই রং খেলার রীতি সমাজ-সংস্কৃতিতে দোল উৎসব হয়ে ওঠে। দোল ফাল্গুনী পূর্ণিমার উৎসব। দোল আর হোলির সেই যুগল ঐতিহ্যকে রবীন্দ্রনাথ বসন্তোৎসবের মধ্যে শ্রীময় ও সুসংস্কৃত করে তুলেছিলেন। তা হয়ে উঠেছিল বর্ণময় ঋতু উৎসব, ‘বসন্তের উৎসব’। তাই প্রচলিত পাঁজির দিনের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবের দিনক্ষণ অনেক সময়েই মিলত না। বাইরে যে দিন দোল বা হোলি নয়, সে দিন হয়তো শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত ও বর্ষা’ নিবন্ধে লিখেছিলেন, “বসন্ত উদাসীন, গৃহত্যাগী। ...বসন্ত আমাদের মনকে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়, ...বসন্তে আমাদের মন অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়া যায়, বাতাসের উপর ভাসিতে থাকে, ফুলের গন্ধে মাতাল হইয়া জ্যোৎস্নার মধ্যে ঘুমাইয়া পড়ে; আমাদের মন বাতাসের মতো, ফুলের গন্ধের মতো, জ্যোৎস্নার মতো, লঘু হইয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। বসন্তে বহির্জগৎ গৃহদ্বার উদ্ঘাটন করিয়া আমাদের মনকে নিমন্ত্রণ করিয়া লইয়া যায়।” যে বসন্তকালে আমাদের মন বহির্জগতে ছড়িয়ে পড়ে— সেই ছড়িয়ে পড়া মনের জন্যই বসন্তোৎসব। গৃহবাসীকে ‘খোল্ দ্বার খোল্’ বলা কেবল ধ্বনিমাধুর্যের রেশ নয়, গানের অলঙ্কার নয়, তার মধ্যে একটি বার্তা আছে। দুয়ারের সঙ্গে সঙ্গে গৃহ, গৃহের সঙ্গে অন্তরটিকে খোলার বার্তা।
এ কথাটি বিশেষ ভাবে বোঝা দরকার। মনের দ্বার রুদ্ধ করে বেঁচে থাকার পক্ষপাতী রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না। কিন্তু মনের দ্বার খুলে দিলে অনেক সময় মন সর্বনাশা নৈরাজ্যে মাতে। কবি চিৎপুরে পাঁক আর কাদা নিয়ে ল্যাঙট-পরা মানুষের হোলি খেলা দেখেছিলেন। সে দৃশ্যে যেমন মনের কোনও বাঁধন ছিল না, তেমনই সে দৃশ্যে শ্রীময়তাও ছিল না। শ্রী অর্জন করতে হয়, অনুশীলনের মাধ্যমে। বসন্তকালে নৃত্যনাট্য পরিবেশনের জন্য অনুশীলন লাগে, গান গাইতে গাইতে পথ চলতে অনুশীলন লাগে। বিক্ষিপ্ত মন পথে নেমে যাতে মুক্তি পায় তারই জন্য যেন বসন্তোৎসবের আয়োজন। কবির শান্তিনিকেতনের বসন্ত-বন্দনা এই মর্মকথাই প্রকাশ করে। মনকে খুলে দিতে হবে, কিন্তু সেই খুলে দেওয়া মনের বিলাসের জন্য যথাযথ উপায় ও উপকরণ প্রয়োজন। না-হলে খোলা মন আদিমতম ও সহজতমকে নিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়বে। উত্তেজনার মত্ততা যখন মিটবে, তখন কাদা আর পাঁকের চিহ্ন-গন্ধে চার পাশ আবিল হয়ে উঠবে। এ অসামঞ্জস্যের নিদর্শন। পাঁকে যেমন অসামঞ্জস্য প্রকাশ পায়, তেমনই উপকরণ বাহুল্যেও অসামঞ্জস্য প্রকাশ পেতে পারে।
রবীন্দ্রনাথের এই বসন্ত বিবেচনা কেবল বসন্তের জন্যই সত্য নয়, দেশ-কালের মানুষের সাধারণ জীবনবোধের জন্যও সত্য। জীবন ও মনকে নানা ভাবে উন্মুক্ত করা জরুরি। জানলা-দরজা বন্ধ করে ভ্রম রোখার চেষ্টা করলে ভ্রম হয়তো সহজে প্রবেশ করে না, কিন্তু সত্যও তার পথ হারায়। উন্মুক্তির দর্শনে বিশ্বাসীরা উন্মুক্তি-যাপনের নৈতিকতা নিয়ে চিন্তা করেন। কবির দেখানো পথে তার সমাধান পাওয়া যেতে পারে। কবির মত বা পথ হল, উন্মুক্তির জীবনযাত্রায় যেন সৌন্দর্যের শ্রী লঙ্ঘিত না হয়। যে কোনও অসামঞ্জস্যই অসুন্দর। ল্যাঙট পরে হোলি খেলার মধ্যে যেমন সামঞ্জস্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়, তেমনই প্রাচুর্যের দমবন্ধ পরিবেশে উৎসব যাপনও প্রকৃতির সঙ্গে অসমঞ্জস। কবির পথটি মধ্যবাদী, তা আদিমতাকে চায় না, উপকরণসর্বস্বতাকেও অগ্রাহ্য করে। মনের মুক্তি খোঁজে কেবল শ্রীময় সহজতায়। বসন্তোৎসব সেই শ্রী আর সহজের উৎসব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy