জোকা থেকে তারাতলা, মোট সাড়ে ছয় কিলোমিটার পথ; সপ্তাহে পাঁচ দিন, দশটা থেকে পাঁচটা, প্রতি ঘণ্টায় একটা ট্রেন। ফাইল চিত্র।
এত দিন যা ছিল শুধু পাহাড়ের গৌরব, এ বার শহর কলকাতাও সে হাসি হাসল। শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপান্তে চালু হল নতুন টয় ট্রেন। তার নাম অবশ্য জোকা মেট্রো। জোকা থেকে তারাতলা, মোট সাড়ে ছয় কিলোমিটার পথ; সপ্তাহে পাঁচ দিন, দশটা থেকে পাঁচটা, প্রতি ঘণ্টায় একটা ট্রেন। অনুমান করা চলে, মানুষের নিত্যপ্রয়োজনে কোনও কাজে লাগবে, এমন উচ্চাশা এই মেট্রো রুটের নেই— এই যাত্রাপথের বহুখণ্ডিত অটো রুটের রুজিরুটিতে মেট্রো হাত দেবে বলে মনে হয় না। তার অস্তিত্বের একমাত্র কারণ হল বিনোদন। দিনকয়েক হল কলকাতায় শীতও পড়েছে জাঁকিয়ে, ফলে ভিক্টোরিয়া-চিড়িয়াখানার পাশাপাশি জোকার টয় ট্রেনও শহরবাসীর আনন্দ-ঠিকানা হয়ে উঠতেই পারে। সোম থেকে শুক্র না চালিয়ে যদি শনি-রবি চালানো হত, তা হলে ফুর্তি জমত আরও। অবশ্য, বাঙালি অফিস কামাই করে আনন্দ করতে জানে; আর, স্কুল-কলেজ-অফিস যাতে কামাই না করতে হয়, তার জন্য মুখ্যমন্ত্রী ছুটিও দিয়ে দিতে পারেন, কিছুই বলা যায় না। যে কোনও ভাবেই হোক, জোকা মেট্রোকে উদ্যাপন করা বাঙালির কর্তব্য। এই মেট্রোর মতো চরিত্রে বাঙালি আর ক’টা জিনিসই বা কলকাতায় আছে? তার কোনও তাড়া নেই— যত দূর যাওয়ার ছিল, বারো বছরে তার এক-তৃতীয়ংশ পথ গিয়েই জোকা মেট্রো খুশি। তার হাড়ভাঙা পরিশ্রম নেই— সকাল দশটায় শুরু, বিকেল পাঁচটায় শেষ, মাঝে ভাতঘুমের বিরতি, শনি-রবি ছুটি। এবং, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। জোকা মেট্রো দিল্লির মতো দূরগামী হতে চায়নি, ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর মতো গঙ্গা পারাপারও করতে চায়নি। এমনকি অমলকান্তির মতো রোদ্দুর হতেও না। জোকা মেট্রো শুধু চেয়েছিল, শীতের রোদ মেখে বাঙালি যেন পুত্র-কন্যার হাত ধরে শহরেই টয় ট্রেন চেপে নিতে পারে। গত বছরের শেষে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
জোকা মেট্রো বাংলার মতোও বটে। তার প্রতিশ্রুতি আছে, কোনও এক দিন সে লাইন তারাতলার সীমানা ছাড়িয়ে, ডায়মন্ডহারবার রোডের মায়া কাটিয়ে ধর্মতলার মোড়ে পৌঁছবে। কবে, সে প্রশ্নের উত্তর নেই। সম্ভবত উত্তর খোঁজেও না কেউ। কলকাতা এক দিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে, শুধু এটুকু জেনেই বাংলা খুশি থাকে— কবিকে বলা যায় না প্রতিশ্রুতি পূরণের দিন তারিখ আদালতে হলফনামা পেশ করে জানাতে হবে। তার ধর্মতলায় পৌঁছনোও অবশ্য খণ্ডিত স্বপ্ন। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, বিবাদী বাগ অবধি যাবে এই মেট্রো। স্বপ্নকে কেটেছেঁটে মধ্যবিত্ত মাপে নিয়ে আসতে বাংলা বিলক্ষণ জানে। এই রাজ্যেই কি উৎকর্ষ কেন্দ্র গড়ে তোলার স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যায়নি, সিঙ্গুরে টাটা মোটরস-এর কারখানা হয়ে যায়নি অগভীর মাছের ভেড়ি? কলকাতার জোকা মেট্রো বাংলার মতো— তার অতীত আছে, উত্তরাধিকার আছে, শুধু ভবিষ্যৎ নেই। কলকাতাতেই চালু হয়েছিল দেশের প্রথম মেট্রো রেল। তার পর আরও চোদ্দোটা শহরে মেট্রো চালু হয়ে গেল, লাইনের সংখ্যায় দিল্লি গুনে গুনে দশ গোল দিল, স্টেশনের সংখ্যায় এগিয়ে গেল হায়দরাবাদ-বেঙ্গালুরুও। একদা সেরা হওয়ার গৌরব নিয়ে বাংলা এখন কায়ক্লেশে দিন গুজরান করে। একদা প্রথম হওয়ার গর্ব নিয়ে কলকাতার মেট্রো তার টয় ট্রেনটি পেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy