—ফাইল চিত্র।
সদ্য গত আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসে জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশ তুলে ধরেছেন বর্তমান ভারতে শ্রমিকদের দুর্দশার কথা, এবং সে দিকে ভয়ঙ্কর প্রশাসনিক ঔদাসীন্যের অভিযোগ। বাস্তবিক, এ বারের নির্বাচনে কংগ্রেস ফের নির্বাচনী লড়াইয়ের অস্ত্র করেছে এই তথ্যকে যে গত এক দশকে খাদ্য-সহ সব অত্যাবশ্যক পণ্যের দাম যত বেড়েছে, তত বাড়েনি শ্রমজীবী মানুষের মজুরি। জয়রাম রমেশ মনে করিয়েছেন, ২০১৪-২০২৩ সময় কালে প্রকৃত মজুরি বাড়েনি, বরং মোদীর দ্বিতীয় দফার শাসনকালে তা কার্যত কমেছে। অর্থাৎ মজুরি বাড়ার হারকে বহু গুণ ছাপিয়ে গিয়েছে মূল্যস্ফীতির হার। তাই শ্রম-নির্ভর মানুষদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তার ফলে বাজারে বিক্রিও কমেছে, বেসরকারি উৎপাদক সংস্থাগুলি বিপাকে পড়েছে, ভাটার টান দেখা দিয়েছে বিনিয়োগে। এর ফলে আর্থিক বৃদ্ধি ধাক্কা খাচ্ছে, বাড়ছে কর্মহীনতা। রমেশের অভিযোগের সত্যতা নিয়ে দ্বিমত নেই, সরকারি তথ্যই তা সমর্থন করে। ২০২২-২৩ সালের আর্থিক সমীক্ষা দেখিয়েছিল, কৃষি এবং অকৃষি ক্ষেত্রে মজুরির টাকার অঙ্ক সামান্য বাড়লেও ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, তাই প্রকৃত মজুরি কমেছে। বিশেষত গ্রামীণ ভারত যে খাদ্য-সহ নানা অত্যাবশ্যক পণ্য কেনা কমিয়েছে, পুষ্টি, শিক্ষা-সহ মানব উন্নয়নের সূচকগুলির উন্নতি দেখা যাচ্ছে না, তা নানা সমীক্ষায় ধরা পড়েছে। এই সব তথ্য প্রকাশের সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে মোদী সরকারের বরাদ্দের ঘাটতি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এর মূলে যে রয়েছে কর্মহীনতা এবং মজুরি ঘাটতি, সে বিষয়টি তেমন আলোচিত হয়নি। নিয়মিত বেতনভুক কর্মচারী, চুক্তিতে নিযুক্ত কর্মচারী বা স্বনিযুক্ত কর্মী, কোনও ধরনের কর্মীরই প্রকৃত বেতন বাড়েনি গত পাঁচ বছরে, মনে করিয়েছেন রমেশ।
বিরোধী দলগুলি, বিশেষত কংগ্রেস ও সিপিআইএম, যে প্রশ্নে বিজেপিকে বিশেষ ভাবে বিদ্ধ করেছে, তা হল ন্যূনতম মজুরি (ন্যাশনাল ফ্লোর লেভেল মিনিমাম ওয়েজ) না বাড়ানো। ২০১৭ সালে ওই মজুরির অঙ্ক বাঁধা হয়েছিল ১৭৬ টাকায়, ২০১৯ সালের নির্বাচনের কিছু আগে তা মাত্র দু’টাকা বেড়েছিল। গত পাঁচ বছরে এক টাকাও বাড়েনি। মোদী সরকারের নিযুক্ত অনুপ শতপথী কমিটি ২০১৯ সালে ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে ৩৭৫ টাকা করার কথা ঘোষণা করেছিল, কিন্তু সরকার তা গ্রহণ করেনি। যদিও কেন্দ্রের ঘোষিত মজুরি দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়, তবু তার প্রভাব পড়ে নানা রাজ্যের সরকার, এবং বেসরকারি ক্ষেত্রের নির্ধারিত মজুরিতে। সাত বছর ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কার্যত না বাড়ায় শ্রমিকের বিপন্নতা বেড়েছে। পাশাপাশি, একশো দিনের কাজের প্রকল্পের প্রতিও মোদী সরকার বরাবরই বিমুখ। এ বছর বাজেটে বরাদ্দের অঙ্ক গত বছরের প্রকৃত খরচের থেকে কমেছে। এতে গ্রামীণ পরিবারগুলির রোজগার অনিশ্চিত হচ্ছে, ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।
অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এই শ্রমিক-বিমুখতার প্রকৃত কারণ দুর্নীতি। নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতিতে স্পষ্ট, বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলি গোপনে কতখানি প্রভাবিত করে বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলগুলিকে। কিন্তু এ ব্যাখ্যাও সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য নয়, শিল্পের উন্নয়নের জন্যই লাগে শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণ। শিল্পক্ষেত্রে তথা দেশের অর্থনীতিতে সুস্থায়ী বৃদ্ধির জন্যই শ্রমিকের যথেষ্ট রোজগার ও সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা জরুরি, তা সারা বিশ্বেই প্রমাণিত। কোভিড-পরবর্তী সময়ে ভারতের শিল্পপতিরা সতর্ক করেছিলেন যে, কর্মহীনতার সুযোগে শ্রমিকদের আইনি ও অন্যান্য সুরক্ষা ব্যাহত করা অনুচিত। শ্রমিক-সুরক্ষার ব্যবস্থার কঠোরতার জন্য ভারতে শিল্পের উন্নতি হচ্ছে না, এমন নয়। শিল্পের স্বার্থ ও শ্রমিকের স্বার্থকে পরস্পর-বিরোধী বলে দেখানো অন্যায়। অথচ, কেন্দ্রের এই অপচেষ্টা রুখতে উদ্যোগী হননি বিরোধীরাও। গত দশকে শ্রমিকের রোজগার ক্ষয়ের বিনিময়ে ভারতে শিল্পক্ষেত্র কতখানি লাভবান হয়েছে, সে প্রশ্ন অতীব জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy