—প্রতীকী ছবি।
ভারতে গৃহস্থালির সঞ্চয়ের হার কমছে— ২০২১-২২ অর্থবর্ষে যা ছিল মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭.২%, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৩ শতাংশে। অন্য দিকে, ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ৫৪% বেড়েছে এই একই সময়কালে। পরিসংখ্যানটি উদ্বেগজনক কি না, সে প্রশ্নে সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ দু’টি অবস্থান গ্রহণ করা সম্ভব। আশাবাদীরা ব্যাঙ্কঋণের চরিত্র বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছেন যে, বর্ধিত ঋণ ব্যবহৃত হচ্ছে মূলত সম্পদ ক্রয়ের জন্য, অথবা জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য। গৃহঋণ যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে গাড়ি কেনার ঋণও। অর্থাৎ, কোভিড-পরবর্তী সময়ে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে নাগরিকদের একটি বড় অংশ আশাবাদী— তাঁরা বিশ্বাস করছেন, ভবিষ্যতে আয় এমন ভাবে বাড়বে যাতে এই ঋণ পরিশোধ করতে তাঁদের কোনও সমস্যা হবে না। ফলে, তাঁরা সঞ্চয়ের কথা না ভেবে জীবনযাত্রার মান উন্নত করার কথা ভেবেছেন, যা আর্থিক সুসময়ের অনস্বীকার্য চরিত্রলক্ষণ। সঞ্চয় কমার ব্যাখ্যা খুঁজতে শেয়ার বাজারের প্রসঙ্গও আসছে। আলোচ্য সময়কালে ভারতে শেয়ার বাজারে গৃহস্থালির লগ্নির পরিমাণ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেড়েছে। মিউচুয়াল ফান্ড এবং সরাসরি একুইটিতে লগ্নির পরিমাণ বেড়েছে। অর্থাৎ, ভারতীয়রা এত দিনে বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে তাল মেলাতে পেরেছেন— তাঁরা বুঝেছেন যে, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজ়িটের সুদ যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন শেয়ার বাজারের অংশীদার হওয়া। অতএব, সঞ্চয়ের পরিমাণ কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এই জোরদার যুক্তি ঠেকে যায় এক জায়গায়, তার নাম আর্থিক অসাম্য। সাম্প্রতিক অতীতে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, আর্থিক অসাম্যের নিরিখে ভারত এখন দুনিয়ায় একেবারে প্রথম সারিতে। এ দেশের ধনীতম এক শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৪০.১%; দেশের মোট আয়ের ২২.৬% উপার্জন করেন তাঁরাই। অন্য দিকে, দেশের দরিদ্রতম ৫০% মানুষ আয় করেন জাতীয় আয়ের মাত্র ১৫%। ফলে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় উন্নতির যে কোনও গড় হিসাবই আসলে প্রবল ভাবে বিকৃত— তা ঝুঁকে রয়েছে ধনীতম দশ শতাংশের দিকে। সঞ্চয় এবং ঋণের হিসাবেও সেই একই গল্প। প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বৃদ্ধির পাশাপাশি ভারতে প্রতিষ্ঠান-বহির্ভূত ঋণের পরিমাণও বেড়েছে। মহাজনি ঋণ অথবা আত্মীয়পরিজন বন্ধুবান্ধবদের থেকে ঋণ নিয়ে মানুষ সচরাচর গাড়ি-বাড়ি কেনে না, সে টাকা খরচ হয় ভাত-কাপড়ের সংস্থানে। অনুমান করা চলে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে দ্বৈত ভারতীয় অর্থব্যবস্থার দীর্ঘকালীন চরিত্রলক্ষণ, বর্তমান সঞ্চয় ও ঋণের ক্ষেত্রেও তেমনই একটি দ্বৈত তৈরি হয়েছে— অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক অবস্থাপন্ন মানুষ জীবনযাত্রার মান বাড়াচ্ছেন, অধিকতর লাভজনক লগ্নির ক্ষেত্র বেছে নিচ্ছেন; আর বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষকে দু’বেলার অন্নসংস্থানের জন্য মাথা কুটতে হচ্ছে।
এই দ্বৈতের কারণেই গড়ের হিসাব বিপজ্জনক। ধনীতম দশ শতাংশের সম্পদ ও আয়ের বিপুলতার কারণে সূচকের গড় মান কখনও দরিদ্রতম ৫০ শতাংশের অবস্থার প্রকৃত ছবিটি দেখায় না। এই ক্ষেত্রেও হিসাব দেখিয়ে নিশ্চিন্তে বলে দেওয়া যায় যে, মানুষ যে-হেতু ভাল থাকতে চাইছেন, সেই কারণেই সঞ্চয়ের হার কমেছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের অবস্থা, বেকারত্বের হার, ভোগব্যয়ের বৃদ্ধির হার তলানিতে গিয়ে ঠেকা, চাহিদার গতিভঙ্গ— অর্থব্যবস্থার কার্যত যে সূচকের দিকেই তাকানো যায়, সেটিই বলবে যে, ভাল থাকার এই আখ্যানের গোড়ায় গলদ রয়েছে। সমস্যা হল, সাধারণ মানুষের পক্ষে এই বৃহত্তর ছবিটি বোঝা অনেক সময় কঠিন— নিজেদের মন্দ অবস্থার জন্য তাঁরা নিজেদেরই দোষ দিতে অভ্যস্ত। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, রাজনীতি এই প্রবণতাটিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। ধনীতমদের সমৃদ্ধিকেই সবার মঙ্গল বলে চালায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy